ক্রাইমবার্তা রিপোট:অপহরণের চার দিন পর কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৫
# টাকা না পেলে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ফেলার হুমকি
# পুলিশ আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারল না
#অপহরণের পর থানায় মামলা
#পুলিশ আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারল না
# অপহরণ নিয়ন্ত্রন করা হয় ভারত থেকে
# পুলিশকে জানানোর কারণেই তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে
সাতক্ষীরা সংবাদদাতাঃ মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণের চার দিন পর কলেজছাত্র গৌতম সরকারের (২০) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল আটটার দিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়নের মহাদেবনগর গ্রামে নিহত কলেজছাত্রের বাড়ির পেছনের পুকুর থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত গৌতম সরকার সাতক্ষীরা সীমান্ত আদর্শ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ঘোনা ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গণেশ সরকারের একমাত্র ছেলে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভাড়খালী গ্রামের শাহাদাৎ মোড়ল, মহসিন আলী, মহাদেবনগরের সাজু শেখ, সুড়িঘাটার নাজমুল হোসেন ও শাওন। এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃত সাজুর বাড়িতে উত্তেজিত জনতা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নিহত কলেজছাত্রের বাবা গণেশ সরকার জানান, তাঁর ছেলে গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে বাড়ির পাশে রহুল আমিনের দোকানে বসে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন। ওই সময় একজন মুঠোফোনে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। গত বুধবার তাঁর কাছে ছেলের মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা চাওয়া হয় মুঠোফোনে। গতকাল শুক্রবার তিনি একই এলাকার ছয়জনকে আসামি করে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি অপহরণের পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। শনিবার সকাল আটটার দিকে বাড়ির পেছনের পুকুর থেকে তাঁর ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ হোসেন মোল্যা ঘটনা নিশ্চিত করে জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক সকালে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কলেজছাত্র গৌতমকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান জানান, গৌতমের লাশ উদ্ধারের পর আসামি সাজুর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কয়েকশ উত্তেজিত জনতা।
এর আগে নিহতের বাবা গৌতমের বাবা গণেশ সরকার অপহরণকারীদের চাহিদামতো টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করেও খোঁজ পাননি ছেলের।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ হোসেন মোল্লা বলেন, ‘আমরা ছেলেটিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম সদর উপজেলার মহাদেবনগরের গণেশ সরকার আরো জানান, গত ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গৌতম ও তাঁর বন্ধুরা বাড়ির পাশে মহাদেবনগর মোড়ে আমিন মিস্ত্রির দোকানে বসে টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছিলেন। এ সময় তাঁর কাছে একটি ফোন আসে। ফোনে তাঁকে ডেকে নেওয়া হয়। এর পর থেকে গৌতমের ফোন (নম্বর ১৭৪৪৬৫০৬০৬ ও ০১৫৫৬৫৫৭৫৬৭ ) বন্ধ পাওয়া যায়।
বাবা জানান, রাতে তাঁর নম্বরে (নম্বর ০১৭২৪৮৪৯৯৭৫) ছেলের নম্বর থেকে ফোন করে বলা হয়, ‘তোর ছেলেকে পেতে চাইলে ১০ লাখ টাকা নিয়ে চলে আয়। তবে পুলিশ কেন, কাউকে জানালেই বিপদ তোর হবে।’ তিনি জানান, বিষয়টি তিনি ঘোনা ইউপির চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ও সাতক্ষীরা থানার ওসিকে জানিয়ে তাদের সহায়তা চান। সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালামসহ পুলিশের কয়েক সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অপহরণকারীদের কথামতো ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে নির্দিষ্ট স্থানে কয়েক লাখ টাকা নিয়ে অপেক্ষা করেন। একপর্যায়ে অন্য সব লোককে সেখান থেকে সরে যেতে বলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, টাকা নিয়ে ওই স্থান থেকে চলে যেতে। পরে বলা হয়, ‘টাকা বিকাশ মারফত পাঠাও।’ তিনি জানান, এরপরই সেখানে আসেন তিনি যুবক। পুলিশ গ্রামবাসীর সহায়তায় তাদের আটক করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ছয়টি মোবাইল ফোন।
গণেশ সরকার জানান, আটক তিনজনের মধ্যে ভাড়ুখালী গ্রামের শাহাদাত মোড়ল মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছিল বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার অপর দুজন হলেন- দেবহাটার বহেরা গ্রামের শাওন ও একই গ্রামের মনিরুল ইসলাম সানি। পুলিশ তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে।
শুক্রবার দুপুরে স্থানীয় জনতা মহাদেবনগরের সন্দেহভাজন যুবক সাজুকে না পেয়ে তার মা ফজিলা খাতুনকে আটক করেছে। তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে। সন্দেহভাজন আরেক যুবক জামশেদ পলাতক। এ ঘটনায় গণেশ সরকার সাতক্ষীরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান জানান, আটক শাহাদাত ভারতের মুম্বাইয়ে থাকেন। তিনি মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।
এদিকে এলাকায় রটনা হয় যে একটি লাশ ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় পড়ে রয়েছে। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কমান্ডার হাবিলদার ইউনুস বলেন, ‘আমরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাছে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি এমন কোনো লাশ কোথাও নেই।’
গৌতমের বাবা গণেশ সরকার জানান, কয়েকদিন আগে এলাকার জামশেদ নামের একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে ছাড়ানোর জন্য তাঁর ওপর চাপ আসে। গণেশ তাতে সাড়া না দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জামশেদ ও তাঁর লোকজন। স্থানীয় আরেক ব্যক্তি আবদুর রহমানের মাধ্যমে পরে জামশেদ থানা থেকে ছাড়া পান। এ সময় গণেশকে হুমকি দিয়ে বলা হয় ‘আমাকে বের করতে সাহায্য করলেন না। এর পরিণতি ভালো হবে না।’
গণেশ জানান, এর পরই তাঁর ছেলে অপহৃত হন। জামশেদ অপরাধজগতের লোক বলে জানায় এলাকাবাসী। তাদের সন্দেহ, গৌতমকে মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে অপহরণ করেছেন জামশেদ ও শাহাদাত। তিনি জানান, অপহরণকারীরা গৌতমের লাশ নিতে ভারতে যাওয়ার জন্যও ডেকেছে। কিন্তু তিনি সে ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। এতে গৌতম অপহরণ ঘটনা আরো রহস্যজনক হয়ে উঠেছে।
এদিকে, মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে তাঁকে যা বলা হয়েছে, গণেশ সরকার তা জিডিতে উল্লেখ করে বলেন, ‘তোর ছেলে আমাদের কাছে আছে। তোর অনেক টাকা-পয়সা আছে। টাকা ও সোনা গয়না নিয়ে আয়। তোর ছেলেকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এ কথা কাউকে জানালে তোর ছেলেকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেব।’
গণেশ সরকার, ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান, সদস্য রবিউল ইসলাম, মুত্তাসিম বিল্লাহ, আবুল বাসার ও মো. সাইফুল্লাহ দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে এসব কথা জানিয়ে গৌতমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারে সংবাদকর্মীদের সহায়তা চান।—