প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উদার মনোভাবের ওপরই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের সফলতা নির্ভর করছে বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজন। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তারা বলেছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাষ্ট্রপতি চাইলে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন করে দিতে পারেন। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে মনে করেন তারা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে রোববার বিকেলে ঘণ্টাব্যাপী সংলাপ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে এই সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। এই সংলাপকে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলেছেন, রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক। তিনি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং চাইলে ইসি গঠনে একটি আইন করে দিতে পারেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করবেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
সংলাপ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন গতকাল সোমবার সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটা প্রয়োজন ছিল। সংলাপের বিকল্প নেই। আমরা চাই, ভবিষ্যতে সবার কাছে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। সবার সঙ্গে কথা বলে রাষ্ট্রপতি ঐকমত্য গড়ার চেষ্টা করছেন। সমাজে ঐক্য আছে। ‘৯০ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর থেকে দেশে একটা ঐকমত্য হয়ে আছে। রাষ্ট্রপতির কাছে এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে চাইলে অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতি সংলাপ আহ্বান করে একটা স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর প্রয়োজন ছিল। তিনি বিএনপির কথা শুনেছেন। তারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা দেখেছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কথাও শুনবেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই মেনে নিতে হবে। সবার মতামত গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী একটি সার্চ কমিটি গঠন করে দেবেন। সেখানে যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাদের দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। তবে যেহেতু এ ব্যাপারে কোনো আইন নেই তাই চাইলে রাষ্ট্রপতি একটি আইন তৈরি করে দিতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে এই সংলাপের মধ্য দিয়ে বরফ গলা শুরু হয়েছে বলে মনে করছি আমরা। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলে সংলাপের মধ্য দিয়ে চলমান সংকটের সমাধান হবে। বিএনপির প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে রাষ্ট্রপতি অভিমত প্রকাশ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি যে উদ্যোগ নেবেন তাই মেনে নেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি চান ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আগামী নির্বাচন যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। তাই নির্বাচন কমিশন গঠনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ছাড় দেওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও তিনি দেশের অভিভাবক। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী উদার মনোভাব ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান সমকালকে বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট দূরীকরণে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ ভালো লক্ষণ। কিন্তু এই সংলাপের মধ্য দিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে বরফ গলবে কি-না সন্দেহ আছে। কারণ রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। তিনি সংবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না। তাই বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সমাধান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে। দুই পক্ষকেই ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পেঁৗছতে হবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমাদের রাজনীতিতে বহু বছর ধরে সংলাপ ছিল না। এখন শুরু হয়েছে। এটা সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ। আশা করব, রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগের ফলে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হবে।
বিএনপি ছাড়াও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপের জন্য আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আজ মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি। আগামীকাল বুধবার এলডিপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে সংলাপ হবে। বৃহস্পতিবার হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগকে এখনও ডাকা হয়নি। তবে বাকি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে পর্যায়ক্রমে আলোচনার জন্য ডাকা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের রাষ্ট্রপতিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই ‘সার্চ কমিটির’ মাধ্যমে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে। সংবিধানমতে এর আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রপতি বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে সংলাপ শুরু করেছেন। –