আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচন করছেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনিই নাসিকের প্রথম মেয়র। এর আগে তিনি ছিলেন বিলুপ্ত নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার শেষ মেয়র। পৌর নির্বাচনের সময় দলীয় সমর্থন পেলেও বিগত ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় সমর্থন-বঞ্চিত আইভীকে দলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে জিততে হয়েছিল লড়াই করে। এবার আইভীর প্রতীক আওয়ামী লীগের নৌকা। দুই দফায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আইভীর ভাবমূর্তি এখনও পরিচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের কাছে।
আইভীর বিপরীতে রয়েছেন বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া রাজনীতিতে ‘আগন্তুকপ্রায়’ মো. সাখাওয়াত হোসেন খান। আইন পেশায় যুক্ত এই মানুষটির পরিচিতির বলয় মূলত আদলত অঙ্গনে। তিন-তিন বার তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হয়েছেন। পেশাগত পরিচিতির বাইরে তাকে ঘিরে যেটুকু আলোচনা, তা-ও সাম্প্রতিক কালের। সাত খুন মামলায় বাদীর আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন তিনি। ধানের শীষ প্রতীককে সম্বল করে ভোটারদের সঙ্গে অপরিচয়ের দুস্তর ব্যবধান কমিয়ে আনতে সাখাওয়াত চেষ্টা নেহায়েত কম করেননি। তবে সঙ্গে পাননি নারায়ণগঞ্জ বিএনপির পরিচিত নেতাদেরও। বিএনপির মনোনয়ন নিতে অস্বীকৃতি জানানো তৈমুর আলম খন্দকার, অ্যাডভোকেট আবুল কালাম, মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন ও এটিএম কামালের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ গত শুক্রবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এই নেতাদের ডেকে নিয়ে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
দলের সামনের সারির নেতাদের মাঠে নামাতে ব্যর্থ হলেও সাখাওয়াত ‘উত্তরপাড়ার আশীর্বাদ পাচ্ছেন’ বলে মনে করেন সন্ত্রাসসবিরোধী ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাবি্ব। ‘উত্তরপাড়া’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন জানতে চাইলে রাবি্ব বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের রাজনীতি বহুকাল ধরে উত্তর ও দক্ষিণপাড়ায় বিভক্ত। হালে উত্তরে শামীম ওসমান এবং দক্ষিণে আইভী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শামীমের বাবা সামসুজ্জোহা এবং আইভীর বাবা আলী আহম্মদ চুনকার আমল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজনীতি উত্তর ও দক্ষিণে দ্বিধাবিভক্ত।
উত্তরাধিকারসূত্রে পিতৃপুরুষের দ্বন্দ্ব বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও ওই নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পাওয়ার পরও শামীম ওসমান স্বতন্ত্র প্রার্থী আইভীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের পর এই দু’জনের সম্পর্ক দা-কুমড়োতে পরিণত হয়। বহুবার বহুজন চেষ্টা করেও তাদের আর এক টেবিলে বসাতে পারেননি। বরং সভাসমাবেশ তো বটেই, টেলিভিশন টক শোতে একে অপরকে দোষারোপ ও গালাগালি দিতে শুরু করেন তারা। শামীমকে আইভী নারায়ণগঞ্জের ‘গডফাদার’ এবং আইভীকে শামীম ‘দুর্নীতির রানী’ আখ্যা দিয়ে সমালোচিত হন। আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং মানববন্ধনের নেপথ্যে ওসমান পরিবারের ভূমিকা সবারই জানা। এমন এক পরিস্থিতিতে এসেছে সিটি করপোরেশন নির্বাচন। আওয়ামী লীগের ওসমানপন্থিরা মেয়র পদের জন্য যাদের নাম প্রস্তাব করেন, তাদের মধ্যে আইভীর নামটিই ছিল না। তবু প্রধানমন্ত্রী আইভীর হাতে নৌকা তুলে দেন এবং নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানকে নির্দেশ দেন আইভীর পক্ষে কাজ করতে।
গত ৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে আইভীর পক্ষে নির্বাচন করার জন্য শামীম ওসমান প্রয়োজনে সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। অথচ ওসমানপন্থিদের কাউকেই মাঠে দেখা যাচ্ছে না বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল। ২৯টি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এ জোটের হয়ে প্রতিদিনই আইভীর পক্ষে ভোট চাইতে যাচ্ছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। জোট বলছে, একটি অশুভ দুর্বৃত্ত চক্র কালিমা লেপন করেছে নারায়ণগঞ্জের মুখে, বারবার রক্তাক্ত করেছে এই জনপদকে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়েই আইভীকে সমর্থন করছেন তারা। ধীমান সাহা জুয়েল জানান, তারা আইভীকে সমর্থন করছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নয়- নারায়ণগঞ্জকে দুর্বৃত্ত মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে। তার মতে, এই দুর্বৃত্তরা জানে আইভী জয়ী হলে তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত লাগবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘প্রয়োজনে তারা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করতেও কুণ্ঠিত হবেন না।’ এই ‘তারা’ কারা জানতে চাইলে, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা আইভীর প্রতিপক্ষ- তারা প্রয়োজনে ভিন্ন দলের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার চেষ্টা করবে এবং সেই ষড়যন্ত্রের আলামত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।’ তার মতে, আইভীর মতো জনপ্রিয় প্রার্থীকে হারানোর অন্য কোনো উপায় নেই। তবে সিটি করপোরেশনের তিন থানার ওসি একটি পরিবারের হয়ে কাজ করছে। এই ওসিরা আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তা হলে সুবিধাটা কে পাবে?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের কর্মিসভায় দেওয়া এক বক্তব্যের কারণে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে নতুন শঙ্কাও যুক্ত হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকারের বাসায় অনুষ্ঠিত কর্মিসভায় গয়েশ্বর বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে ‘বাঘ’ থাবা দেবে না, ‘বিড়াল’ খামচি দিতে পারে।’ বিএনপি কর্মীরাই বলছেন, ‘বাঘ’ বলতে শামীম ওসমানকে এবং ‘বিড়াল’ বলতে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বোঝানো হয়েছে।
বারবার চেষ্টা করেও এসব ব্যাপারে শামীম ওসমানের বক্তব্য জানা গেল না। তবে সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘এসব বাজে কথা। এগুলো শুধু আপনাদের মুখেই শুনি। নারায়ণগঞ্জ নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল বলেন, ‘এগুলো আইভীপন্থি নেতাদের তৈরি করা অপপ্রচার। বিএনপি প্রার্থীকে কেন আওয়ামী লীগ পরিবারের কারোর সমর্থনের ওপর ভরসা করতে হবে?’
আইভী এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে নারাজ। অবশ্য এরই মধ্যে আইভী ‘তৃতীয় শক্তি’ সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান রাখতে শুরু করেছেন। এমন কথা আইভী প্রথম বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের উপস্থিতিতে। ১৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে মতবিনিময় করেন। সেখানে আইভী বলেন, ‘তৃতীয় শক্তি নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করতে পারে।’ এখন আইভী এসব কথাবার্তা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আমি এখন এই সব কূটতর্কে জড়াতে চাই না। আমি এখন যত বেশি মানুষের কাছে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টায় আছি।’
আইভীর একনিষ্ঠ সমর্থক রফিউর রাবি্বও মনে করেন, প্রার্থী হিসেবে সাখাওয়াত কোনোভাবেই আইভীর তুল্য নন। রাবি্ব এই দুই প্রার্থীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মনোনয়নের আগে আইভী ছিলেন ১৪ আনা, সাখাওয়াত দুই আনা। কিন্তু নির্বাচনটা যখন নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে, তখন প্রার্থীটা কে এটা আর খুব গুরুত্বপূর্ণ থাকে না।’ তবে আইভীর পক্ষে রাবি্ব নিজে যতটা জনসংযোগ করেছেন, তা থেকে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। কারণ নৌকার সমর্থকদের পাশাপাশি আইভীর ব্যক্তিগত ভোটারও অনেক। তাছাড়া অনেকের ধারণা, দোদুল্যমান ভোটার, যারা প্রতীক দেখে ভোট দেন না, তাদের সমর্থন আদায়ে সাখাওয়াত বলতে গেলে পুরোপুরি ব্যর্থই হয়েছেন।সমকাল