ক্রাইমবার্তা স্পোর্টস ডেস্ক:ক্রিকেটে বোলারদের কাজটা কী? বোলিং করা! নিজের সুবিধামতো একটা রানআপ বেছে নাও আর দৌড়ে এসে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে ঘায়েল কর—খুব সহজ! কীভাবে উইকেটটা এল, সোজা বল না স্পিনে, ফুলটসে না ইয়র্কারে—সেটা দেখারও দরকার নেই। বোলাররাও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছেন আর নিজের ইচ্ছে আর খুশি মতো বোলিং করছেন। তবে এঁদের মাঝেও কয়েকজন আছেন যাঁদের বোলিং দেখলে মনে হতেই পারে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল বোধ হয়। না হলে এভাবে বল করতে যাবেন কেন!
অবশ্য ইতিহাস বলে, বর্তমানে যেটা স্বাভাবিক বোলিং সেটাই ছিল এক সময়কার অদ্ভুতরে অ্যাকশন। ১৮ শতকের প্রথমদিকে কোমরের নিচ থেকেই বল ছোড়ার নিয়ম ছিল। ভাগ্যিস বোন ক্রিস্টিন উইলিসকে বল করতে বাধ্য করেছিলেন তাঁর ভাই জন উইলিস। স্কার্টের বেড়ের কারণে ‘আন্ডারআর্ম’ বল ছুড়তে অসুবিধা হওয়ায় ক্রিস্টিন কাঁধের ওপর থেকে বল করেছিলেন সেদিন। অদ্ভুতরে সে বোলিংটা তখন চোখ রাঙিয়েছিল বিশুদ্ধবাদীদের। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৮৬৪ সালে বৈধতা মিলেছিল সে বোলিংয়ের।
এরপর অনেক পথ পেরিয়েছে ক্রিকেট। ওভারআর্ম বোলিংকেই আদর্শ মেনে নিয়ে শুদ্ধতম বোলিং অ্যাকশনে বোলিং করে গেছেন অনেকেই। গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো অনেকেই এসেছেন , যাঁদের অ্যাকশন দেখে রোবট বলেই ঠাউরেছেন সবাই। ভাগ্যিস, ম্যাকগ্রাদের ভিড়েও পল অ্যাডামসরা জন্মেছেন, আর চমকে দিয়েছেন ক্রিকেটকে।
পল অ্যাডামস
দক্ষিণ আফ্রিকান এই বোলার যদি স্বাভাবিকভাবে বল করতেন তাতেই সংবাদ শিরোনাম হতেন। অনেক দিন পর যে ক্রিকেট একজন বাঁহাতি লেগ স্পিনার বা চায়নাম্যান বোলার পেয়েছিল। কিন্তু অ্যাডামস যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন স্তব্ধ করে দেবেন সবাইকে। স্বাভাবিকভাবেই দৌড়ে আসতেন, কিন্তু বল ছাড়ার মুহূর্তেই দেখা যেত চোখমুখ কুঁচকে বল ছাড়ছেন অ্যাডামস। এমনকি বল ছাড়ার সময়ও শরীরটা এমনভাবে রাখতেন যে ব্যাটসম্যানকে দেখার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না তাঁর! প্রাথমিকভাবে এই অ্যাকশনে সাফল্য পেলেও পরে ঠিকই হারিয়ে গেছেন পল।
তাঁকে অনুকরণ করে বাংলাদেশেও একজন বোলিং করতেন। ১৯৯৮ নক-আউট বিশ্বকাপে যাকে দেখে নাম দেওয়া হয়েছিল পল-কুদ্দুস!
লাসিথ মালিঙ্গা
নানা বর্ণের চুল, বর্ণিল ভ্রু, আশপাশে কিছু রিংও আছে। এমন ভয়ংকর রূপ নিয়ে দৌড়ে এসে আচমকা ছাড়তেন বলটা। যেন আম্পায়ারের টাইয়ের ঠিক সামনে থেকে ছুটে আসছে গোলা। শ্রীলঙ্কান এই ফাস্ট বোলারের সামনে পড়ে হতভম্ব হয়ে পড়তেন অধিকাংশ ব্যাটসম্যানই। এই স্লিঙ্গিং অ্যাকশন দিয়েই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকটা মাতিয়েছেন মালিঙ্গা। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ডাবল হ্যাটট্রিকও তাঁর।
মুত্তিয়া মুরালিধরন
ইতিহাসের সেরা অফ স্পিনারটির নাম মুত্তিয়া মুরালিধরন। অথচ এই কিংবদন্তিকে পুরো এক ওভার খেলে অ্যালান বোর্ডার ড্রেসিংরুমে এসে বলেছিলেন, ‘আরে ছেলে লেগ স্পিন করে!’ বোর্ডারের আর দোষ কি! মুরালিধরন না এলে কেউ তো কখনো কল্পনাও করতে পারতেন না, কবজি দিয়েও অফ স্পিন বোলিং হয়। ‘ওপেন চেস্ট’ অ্যাকশন, ডান হাতের জন্মগত ত্রুটি, কবজির অস্বাভাবিক নমনীয়তা ও কোমরের ব্যবহার দিয়ে অবিশ্বাস্য এক অ্যাকশনে বল করতেন মুরালি। তেরো শরও বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট বলছে , তাতে তিনি সফলও।
সোহেল তানভীর
সোহেল তানভীরও করেন অবিশ্বাস্য এক কর্ম। তিনি ভুল পায়ে ল্যান্ড করেই বোলিং করে যাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সাধারণত বোলাররা যে হাতে বল করেন, ডেলিভারির সময় তার বিপরীত পা মাটিতে থাকে। কিন্তু তানভীর বাঁহাতি হওয়া সত্ত্বেও বল ছাড়ার সময় তাঁর বাঁ পা থাকে মাটিতে। ডান পাটা ফেলেন বলটা ছুড়ে দেওয়ার পর। তাঁর এই অদ্ভুতুরে বোলিং অ্যাকশন শুরুতে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছিল তাঁকে।
জেফ টমসন
অলিখিতভাবে সর্বকালের সবচেয়ে দ্রুতগতির বোলার তিনি। তাঁর বোলিংটাও ছিল অদ্ভুত। বল করার আগে এক ঝটকায় ডান হাতকে বাম কোমরের পেছনে নিয়ে টেনে ছুড়তেন বল। স্লিঙ্গিং অ্যাকশনের প্রথম বোলার তিনিই। প্রথম দিকে এতটাই ভয়ংকর ছিলেন, ইয়ান চ্যাপেলকে একবার বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘সে বোধ হয় ব্যাটসম্যানকে খুন করতে আসছে!’
মাইক প্রক্টর
এই দক্ষিণ আফ্রিকানের বোলিংটা ছিল ‘ওপেন চেস্টেড’। এখানেই থামেনি তাঁর বিশেষত্ব, বল ছাড়ার আগে দুবার হাত ঘোরাতেন তিনি। এমন অ্যাকশনের কারণে লেট সুইং পেতেন। যেটা মাত্র ৭ টেস্টেই ৪১ উইকেট এনে দিয়েছিল তাঁকে।
কলিন ক্রফট
এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান যখন দৌড়ে আসতেন তখন মনে হতো, ব্যাটসম্যান নয় বরং গালি ফিল্ডারকে লক্ষ্য করেই বোধ হয় বোলিংটা করছেন! শেষ মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে হাতটা ঘুড়িয়ে নিয়ে ঠিকই স্টাম্পে বল করতেন। তবে সেটা যতটা না আউট করার জন্য তার চেয়ে বেশি ব্যাটসম্যানের গায়ে লাগিয়ে আহত করার উদ্দেশ্যে!
দেবাশীষ মোহান্তি
এই ভারতীয় বোলার অনেকটা ধূমকেতুর মতোই দেখা দিয়েছিলেন। আচমকা সুযোগ পেয়েছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। বল করার আগে হাতটা দুবার ঘুরিয়ে নিতেন। তারপর চোখ মুখ উলটে ভয়ংকর এক মুখ করে বল ছাড়তেন ব্যাটসম্যানদের দিকে। বলের গতি নয়, এই অ্যাকশনই তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছে বেশি।