রেলে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস

ক্রাইমবার্তা রিপোট: রেলওয়ের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষার প্রশ্ন বৃহস্পতিবার রাতেই ফাঁস হয়ে প্রার্থীদের হাতে চলে যায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই শুক্রবার চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আগের রাতে হাতে পাওয়া প্রশ্ন এবং পরীক্ষার হলে দেয়া প্রশ্ন হুবহু এক। ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে ১৮০ জনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য এ পরীক্ষা নেয়া হয়।

এ ঘটনায় চাকরি প্রার্থীসহ অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা এ পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পরীক্ষা কমিটিসহ রেলওয়ের একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত বলে রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্র এবং পুলিশ জানিয়েছে। নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চিফ পার্সোনেল অফিসার অজয় পোদ্দারের অফিস ঘিরেও সন্দেহ দানা বাঁধছে। তার তত্ত্বাবধানেই প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। প্রশ্নগুলো তিনিই সংরক্ষণ করেন। পরীক্ষার্থীদের কাছে ছড়িয়ে পড়া হাতের লেখা প্রশ্ন এবং সাদা কাগজে ছাপানো প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে। প্রশ্নপত্রের হাতের লেখার সঙ্গে এই কর্মকর্তার হাতের লেখারও মিল আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞদের মতে তদন্ত করলেই এর প্রমাণ পওয়া যাবে। রেলওয়ের শ্রমিক নেতারা নিয়োগ পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে পরীক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এজিএম আমজাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও সংরক্ষণসহ সব কাজই করেছেন কমিটির আহ্বায়ক। তার কাছেই প্রশ্নগুলো থাকার কথা। কীভাবে ফাঁস হল তা বোঝা যাচ্ছে না। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের শনাক্তের পর এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, সাড়ে আট হাজার প্রবেশপত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর শতকরা ৫০ ভাগ আবেদনকারী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।

নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চিফ পার্সোনেল অফিসার অজয় পোদ্দারের সঙ্গে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু শুক্রবার দিনভর তার সরকারি নম্বরের ফোনটি বন্ধ ছিল। রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জানা গেছে, রেলওয়ের ট্রেড অ্যাপ্রেনটিসের ১৮০টি শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে ৬০ নম্বরের এই লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। বাকি ৪০ নম্বর মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত। পরীক্ষায় মোট নম্বর ছিল একশ’। শুক্রবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় পরীক্ষা। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে কিছু পরীক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যায়। সচেতন একাধিক পরীক্ষার্থী শুক্রবার রাতে যুগান্তরের কাছে হাতের লেখা এবং ছাপানো দুই ধরনের প্রশ্নপত্রই পাঠিয়ে দেন। প্রথমে রাত ১২টা ২৮ মিনিটে হাতের লেখা দুটি প্রশ্ন যুগান্তরের হাতে পৌঁছায়। এরপর রাত ১২টা ৩৩ মিনিটে ছাপানো একটি প্রশ্ন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুগান্তরের কাছে আসে। পরীক্ষার হলে দেয়া পরীক্ষা এবং রাতে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। হাতের লেখা প্রশ্নে সিরিয়ালে মিল না থাকলেও প্রশ্ন একই দেখা গেছে। হাতের লেখায় দশ নম্বর ধারা ক্রমে যে প্রশ্ন আছে, তা ছাপানো প্রশ্নপত্রের ৫৪ নম্বরে দেখা গেছে। হাতের লেখা ধারাক্রমে ১৬ নম্বরে যে প্রশ্ন করা হয়েছে, তা ছাপানো প্রশ্নের ৬০ নম্বরে রাখা হয়েছে। তবে পরীক্ষার হলে দেয়া ছাপানো প্রশ্ন এবং আগের রাতে ফাঁস হওয়া ছাপানো প্রশ্নের মধ্যে হুবহু মিল পাওয়া গেছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাই শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টার দিকে যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। তবে অনেক দুষ্ট লোক আছে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনবে কিনা তা পরীক্ষার্থীদের কাছে জানতে চায়। রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন কিনা এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে ২-১ জন আমাকে বলেছেন। তাদের প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছি তাহলে আপনারা পেপার, পত্রিকায় দিয়ে দিতেন। যদি রাত ১টার দিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হতো তাহলে আপনারা অনলাইনে দিতেন। সে ক্ষেত্রে আমরা পরীক্ষা বাতিল করে দিতাম।

জিএম বলেন বলেন, নিয়োগ নিয়ে কোনো অনিয়ম সহ্য করা হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, আমরা প্রায় দেড় হাজার পরীক্ষার্থীর জন্য চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে সেন্টার করেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তকর্তা বলে দিলেন, আপনাদের জায়গা দিতে পারছি না। অনেক অনুরোধ করলাম তারপরও জায়গা দিল না। পরে বাধ্য হয়েই পরীক্ষার্থীদের রেলওয়ের ২টি বাস দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে রেলওয়ে স্কুলে নিয়ে আসা হয়। এ কারণে ৪০ মিনিট পর পরীক্ষা শুরু হয়।

ট্রেড অ্যাপ্রেনটিস পদে নিয়োগ পরীক্ষার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) জুবেদা আক্তার জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কিনা তা বলতে পারব না। তবে প্রশ্নপত্র তৈরি কিংবা পরীক্ষার সময় আমাকে রাখা হয়নি। নিয়োগ পরীক্ষা স্বচ্ছ করার বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

নিয়োগ কমিটির অন্য সদস্য পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক সুজিত কুমার যুগান্তরকে বলেন, শুক্রবার রাজশাহীর তিনটি কেন্দ্রে পরীক্ষা নেয়া হয়। পরীক্ষা কেন্দ্রে তিনি ছিলেন না, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কিনা তা তিনি জানেন না।

রেলওয়ের স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা লোকমান হোসেন বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকলে পরীক্ষা নেয়ার কোনো মানে হয় না। পরীক্ষা নেয়া তামাশা মাত্র। দায়ীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি জোর দাবি জানান।’

রেলওয়ের আরেক শ্রমিক লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই পরীক্ষা নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক।’

জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ এবং রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড স্কুল কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছেন। সব কেন্দ্রেই পরীক্ষার আগে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছেন পরীক্ষার্থীরা। আবুল কালাম নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে রেলের কর্মকর্তারা জড়িত। এখানে পরীক্ষার্থীদের দায়ী করলে হবে না।’ তিনি প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নেয়া হলে পরীক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দাবি করেন।

Check Also

যশোরে মধুমেলার জায়গা বরাদ্দ নিয়ে বিএনপির দুগ্রুপের হাতাহাতি

যশোরে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র ২০১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী ‘মধুমেলা’র জায়গা ও ইভেন্ট বরাদ্দের উন্মুক্ত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।