‘শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি’ এই তিন নীতি নিয়ে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। কিন্তু সাত দশকের এই পথচলায় সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে কিছু নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। ছাত্রলীগকে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্যÑ এগুলো এখন নিত্যসঙ্গী। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে অভ্যন্তীরণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। এজন্য প্রায়ই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে থাকায় গঠনমূলক কাজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পুরনো ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনটির। কেন্দ্র থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার পরও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না।
সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে আসা সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিসকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। এ ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সমালোচনায় বিদ্ধ হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে ছাত্রলীগ হাইকমান্ড। এ ঘটনায় শুধু ছাত্রলীগ নয়, সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। অবশ্য সেই বদরুল রেহাই পাননি। সংগঠন থেকে বহিষ্কার হওয়ার পাশাপাশি এখন তিনি কারাগারে। গত ২৭ অক্টোবর গুলিস্তান পাতাল মার্কেট এলাকার ফুটপাথ থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদের সময় হকারদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের দুই নেতার আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও গোলাগুলি করার ঘটনায় সংগঠনটির ভাবমর্যাদা কম ক্ষুণœ হয়নি। ওই দুই নেতাকে শেষমেষ বহিষ্কার করে পার পাওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রলীগ। গত ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের খাবার নিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা, ৮ ডিসেম্বর ঠুনকো বিষয় নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি সুজনের অনুসারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও আহত এবং ২৯ ডিসেম্বর রাতে ঝিনাইদহে সরকারি ভেটেরিনারি কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। গত বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামে রহস্যজনক মৃত্যু হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইফরান চৌধুরীর। এই মৃত্যু সংগঠনের স্থানীয় বিরোধ বলে অভিযোগ উঠেছে। এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে। এইসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ছাত্রলীগের পথশিশুদের শিক্ষা উপকরণ দান, গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা, বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিসহ নানা ইতিবাচক কর্মসূচি পালন করে সুনাম কুড়ালেও সব অর্জন চাপা পড়ে যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখন ছাত্রলীগের দেখভাল করছেন। ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও সুনাম অক্ষুণœ রাখতে তিনি সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে ওবায়দুল কাদের কয়েক দফা মতবিনিময় সভা করেছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নেতিবাচক খবর না হতেও ছাত্রলীগকে শপথবাক্য পাঠ করান আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পদাক।
নেতাকর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে সংগঠনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্রলীগ একটি বৃহৎ সংগঠন। দুই-একজন নেতাকর্মী কিছু অপরাধ করছে, এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। তবে দেখতে হবে যারা অপরাধ করছে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠন ব্যবস্থা নিচ্ছে কিনা। অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কোনো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দায়ভার সংগঠন নেবে না। সামনেও সংগঠনের ভাবমর্যাদা অক্ষুণœ রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো নেতাকর্মী অপরাধ করে পার পাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রদের সংগঠন, সেহেতু ছাত্রদের অধিকার আদায়ে আমরা সর্বদা তৎপর। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে সব ইতিবাচক কর্মসূচি আমরা পালন করে আসছি। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রসঙ্গে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অপরিহার্য দায়িত্ব হচ্ছে আদর্শিক লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, আদর্শ ও আত্মত্যাগই কেবল অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্বৃত্তায়ন এবং সব অপকর্মকে দূরীভূত করতে পারে। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, বর্তমান ছাত্রলীগকে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিজেদের নির্মাণ করা জরুরি। তাদের দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশের অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে হবে। ছাত্রলীগ সব ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ড’ ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করতে বদ্ধপরিকর।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবমুখর করতে নয়টি উপ-কমিটি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী কর্মসূচি প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা জানান, এদিন ভোর ৬টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হবে। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ৬টায় সারা দশের সব ইউনিটে একযোগে সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৮টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। শাহজাদা আরো জানান, সকাল ১০টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে একটি র্যালি বের হবে, যা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হবে। এ ছাড়া ৫ জানুয়ারি স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, ৬ জানুয়ারি গরিব ও হতদরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং টিএসসি মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৮ জানুয়ারি পথশিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হবে।
জাগপা ছাত্রলীগ : এ দিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (জাগপা) ৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সকালে দলীয় কার্যালয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া আগামী ১৩ জানুয়ারি ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন জাগপা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম।নয়া দিগন্ত