এমপি লিটন হত্যা আলামত ঘিরে নানা সন্দেহে গোয়েন্দারা – খুনির ক্যাপের ডিএনএ পরীক্ষা

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা, গাইবান্ধা ও সুন্দরগঞ্জ প্রতিনিধি
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কিছু আলামত নিয়ে গোয়েন্দারা নানা সন্দেহে ঘুরপাক খাচ্ছেন। হত্যার ধরন ও ব্যবহৃত গুলির সংখ্যা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এর পেছনে উগ্রপন্থিদের হাত রয়েছে। আবার ঘটনার দিন বাসার পরিবেশ ও লিটনের ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের বিষয়টি কীভাবে খুনিরা আগেই জানতে পারল, তা দেখে কেউ কেউ মনে করছেন, ঘনিষ্ঠ কেউ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এ ছাড়া জামায়াত-শিবিরবিরোধী কট্টর মানসিকতার হওয়ায় কারও ধারণা, ওই চক্রই পরিকল্পিতভাবে লিটনকে হত্যা করেছে

পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই এসব তারা প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। এদিকে ঘটনাস্থলের অদূরে পাওয়া একটি ক্যাপের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় আলামত পাঠানো হয়েছে। তবে লিটন হত্যার ছয় দিন পার হলেও জড়িত কাউকে গ্রেফতারের কথা জানাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গত বুধবার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ‘ভালো খবর’ দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হলেও গতকাল পর্যন্ত সেই খবর মেলেনি।

এ বিষয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে। পিবিআইর একাধিক দল কাজ করছে।

জঙ্গিদের তৎপরতার ওপর খোঁজ রাখেন এমন একজন কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, জেএমবি বা এবিটি বিভিন্ন অপারেশনে ৪-৫টি গুলি করেছে। লিটনের ক্ষেত্রে মোট পাঁচটি গুলি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন জঙ্গি অপারেশনে স্লিপার সেলের ৪-৫ জন সদস্য যুক্ত ছিল। লিটনের ঘটনায় হত্যা মিশনে অংশ নেয় ৫ জন। এমনকি অতীতে জঙ্গিদের আস্তানা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, তারা মন্ত্রী ও এমপি হত্যারও ছক করেছিল। এসব আলামত জঙ্গিদের জড়িত থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়। তবে এর বিপক্ষে ওই কর্মকর্তার যুক্তি, হলি আর্টিসানের পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে লিটনকে হত্যার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। জামায়াত-শিবির জঙ্গি আদলে এটি করতে পারে_ সে আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আরেকটি সূত্র বলছে, ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে সৈয়দপুর হয়ে বিমানে এমপি লিটনের ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। বিমানের টিকিট না পেয়ে তিনি ১ জানুয়ারি রোববারের টিকিট নিয়ে আসেন। আর এ কারণেই শুক্রবার রাতেই লিটন সিদ্ধান্ত নেন শনিবারের পরিবর্তে রোববার তিনি ঢাকায় যাবেন। এমপি লিটনের নির্দিষ্ট দিনে বিমানের টিকিট না পাওয়ার কারণে আকস্মিক যাত্রাবিরতির সুযোগকে কীভাবে খুনিরা বেছে নিল। সেদিন ঢাকায় না যাওয়াকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের বাড়ি নেতাকর্মী শূন্য থাকবে_ খুনিরা এই তথ্য কীভাবে পেল। এ ছাড়া যারা সার্বক্ষণিক বাসায় থাকত, সেদিন তারাই বা ছিলেন না কেন? এ প্রশ্নগুলো নিয়েও পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

লিটন হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যে ৩৫ জনকে পুলিশ আটক করেছিল, তাদের সবাই জামায়াত-শিবির ও ‘আল্লাহর দলের’ ক্যাডার এবং সমর্থক। ওই সন্দেহভাজন আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের মধ্যে ২১ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তারা হলো_ মহসিন আলী, সিরাজুল ইসলাম, রাতুল ইসলাম, লাল মিয়া, আইয়ুব আলী, আলম মিয়া, সানু মিয়া, ভুট্টু মিয়া, আমজাদ হোসেন, রুবেল মিয়া, আজিজুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, মাহাতাব হোসেন, হাফিজ উদ্দিন, মোজাম্মেল হক, নুরুন্নবী, গোলাম বারী, মমিন উদ্দিন, আবদুল মালেক, মঈন উদ্দিন ও আবদুল খালেক।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এমপি লিটন হত্যার দিন বাড়ির সামনের গাবগাছের দক্ষিণ দিকে পড়ে থাকা কালো রঙের একটি ক্যাপ উদ্ধার করা হয়। বিকেলে সামনের মাঠে যারা ভলিবল খেলছিল, তারাই ক্যাপটি কুড়িয়ে পেয়ে পুলিশকে দেয়। সূত্রটি আরও জানায়, যে দুই খুনি এমপিকে হত্যা করতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছিল, তাদের গায়ে ছিল কালো রঙের জ্যাকেট, পড়নে কালো প্যান্ট আর মাথায় কালো রঙের ক্যাপ। ধারণা করা হচ্ছে, গুলি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো ঘাতকদের কারও মাথা থেকে ক্যাপটি পড়ে যায়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন পুলিশের পক্ষে প্রকৃত খুনি শনাক্ত করতে উলেল্গখযোগ্য সূত্র হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, ঘটনার সময় লিটনের বাড়িতে নেতাকর্মীশূন্য থাকার বিষয়টি নিয়েও সুন্দরগঞ্জে আলোচনা চলছে। লিটন যখন বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে বা সভা-সমাবেশে যেতেন, তখন দলীয় ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মী সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে থাকতেন। তাদের মধ্যে উলেল্গখযোগ্য সামিউল ইসলাম সামু, খন্দকার মাইদুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম রানা ও আজম আলী। কিন্তু ঘটনার দিন তাদের কেউ এমপির বাড়িতে ছিলেন না। এ বিষয়ে সামিউল ইসলাম সামু জানান, থার্টিফার্স্ট নাইট হওয়ায় ওই দিন অনেকে বিভিন্ন কারণে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যায় প্রতিদিনের মতো এমপি লিটনের বামনডাঙ্গা অফিসে আসার কথা থাকায় সেখানেই নেতাকর্মীরা এমপির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

এমপি লিটনের কোল্ডস্টোরের ম্যানেজার আইয়ুব আলী জানান, ৩১ ডিসেম্বর বিমানের টিকিট না পেয়ে ১ জানুয়ারির টিকিট তিনি নিয়ে আসেন। আর এ কারণেই এমপির ঢাকা যাওয়ার তারিখ পরিবর্তন হয়। বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সমেস উদ্দিন বাবু বলেন, লিটনের খুনের সঙ্গে জামায়াত-শিবির চক্র জড়িত।

এমপির স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবং তার একমাত্র সন্তান সাকিব সাদমান রাতিন লিটনের বোনদের সঙ্গে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। রাতিনসহ এমপির স্বজনের পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।সমকাল।

 

Check Also

আশাশুনিতে টঙ্গী ইজতেমায় হত্যার বিচারের দাবিতে মানববন্ধন

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।ঢাকার টঙ্গীত ইজতেমা-মাঠে নিরীহ মুসল্লিদের উপর উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সাদ পন্থীদের বর্বরোচিত হামলা ও পরিকল্পিত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।