শ্রীমঙ্গলে শ্রমিক-বিজিবি সংঘর্ষে গুলি, ভাংচুর : আহত অর্ধশতাধিক

ক্রাইমবার্তা রিপোট: মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ড্রাইভার শ্রমিকদের সাথে বিজিবির সংঘর্ষে শহর জুড়ে রনক্ষেত্রে পরিণত হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত ঘটে এই ঘটনা। এসময় বিজিবির এলোপাতারি গুলি ও লাঠিচার্জে আহত হয়েছে শিশু ও মহিলাসহ কমপক্ষে অর্ধশত সাধারন পথচারী ও ব্যবসায়ী।

ভানুগাছ রোড, ষ্টেশন রোড, কলেজ রোড, হবিগঞ্জ রোডের বেশ কয়েকটি দোখানপাট ভাংচুরসহ অন্তত শতাধিক যানবাহন ভাংচুর করা হয়। বিজিবি সদস্যরা বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্যে ভাংচুরের করে দোখান মালিক ও কর্মচারীদের মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংঘর্ষ চলাকালে ব্যবসায়ী ও পথচারীদের আতংক ছড়িয়ে পড়ে। যে যেভাবে পারে পালাবার চেষ্টা করেন পথচারীরা। ব্যবসায়ীরা বন্ধ করে দেন তাদের দোখান পাট। মৌলভীবাজার থেকে রিজার্ভ পুলিশসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে পৌছলে প্রায় দুই ঘন্টা বন্ধ থাকার পর ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহা-সড়কসহ শহরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষনিকভাবে চৌমূনা চত্তরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে সড়কে আগুন জালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। পরে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের অনুরুধে সেখান থেকে সড়ে যায় তারা।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদ এমপি। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহন ও ব্যবসা প্রতিষ্টান ঘুরে দেখেন। রাত সাড়ে দশটায় ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিক নেতারা এক সাথে মিলিত হয়ে আবারও প্রতিবাদ সমাবেশ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্টান ও পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেন। এতে শহরজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ঘটনার ব্যখ্যা দিয়ে শ্রীমঙ্গলস্থ ৪৬ বিজিবির পক্ষ থেকে শুক্রবার দুপুরে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয় ৫ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গল সেক্টরের অতিরিক্ত পরিচালক অপারেশন মেজর মো: মিন্নাত আলী এবং ভারপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার মেজর মো: মাহতাবুল হাসান সরকারী জীপ যোগে বিওপি পরিদর্শন শেষে আনুমানিক ৪টা ৫০ মিনিটের সময় শ্রীমঙ্গল শহরতলীর উত্তরসুর এলাকায় সখিনা সিএনজি ফিলিং ষ্টেশনের নিকটে পৌছালে ফিলিং ষ্টেশনের ভিতর থেকে একটি কালো রং এর হাইস মাইক্রোবাস কোন সিগন্যাল না দেখিয়ে বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালিয়ে হঠাৎ রাস্তায় উঠে আসে। মেজর মো: মিন্নাত আলী মাইক্রোবাসকে থামিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে এভাবে বেপরোয়াভাবে গাড়ী চালানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ড্রাইভার দু:খ প্রকাশ না করে বরং ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং উদ্ব্যতপূণ আচরণ করে । তখন মেজর মো: মিন্নাত আলী তাকে ধমক ও বকাবকি করলে সে ‘সরি’ বলে মাইক্রোবাস নিয়ে বিজিবি’র গাড়ীর পিছনে পিছন আসতে থাকে । সন্ধ্যো সোয়া ৫টার দিকে বিজিবি’র জীপটি ভানুগাছ সড়কের পানসী রেষ্টুরেন্টের সামনে এলে মেজর মো: মিন্নাত আলী অনেক লোকজন রাস্তার উপর দাঁড়ানো অবস্থায় দেখেন এবং এসময়ে কালো মাইক্রোবাসটি দ্রুত গতিতে বিজিবি’র জীপের সামনে এসে গতি রোধ করে দাঁড়ায়। বিজিবি’র জীপের ড্রাইভার এবং দ্বিতীয় আসন ধারীকে উপস্থিত লোকেরা ইউনিফরমের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে গাড়ী থেকে নামিয়ে মারধর করতে করতে পানসী রেষ্টুরেন্টের ভিতরে নিয়ে যায় । পানসী রেষ্টুরেন্টের সামনে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের সহায়তায় বিজিবি’র অফিসারদ্বয় চালককে মাথা ফাটা আহত অবস্থায় উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল সেক্টরে নিয়ে যায় । পরবর্তীতে পনে ছয়টার দিকে মেজর মো: মিন্নাত আলী উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সনাক্ত করতে পানসী রেষ্টুরেন্টের সামনে আসেন । ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর হাজার বার’শ লোকজন রাস্তার বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়েছে এবং দোকান পাট ভাংচুর করছে এবং বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকে এবং বিজিবি’র লোকজন দেখা মাত্রই তারা বিজিবি’র দিকে আসতে শুরু করে এবং বৃষ্টি ন্যায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে । উক্ত ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় বিজিবি’র ০২ জন সদস্য গুরুতর আহতসহ মোট ০৮ জন সদস্য আহত হয়। বিজিবি সদস্যদের জীবন ও সরকারী মাল রক্ষার্থে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আনুমানিক সাড়ে ৬টায় বিজিবি কতৃক দুই ধাপে ১৫ রাউন্ড ফায়ার করা হয় । পরবতীতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নিবাহী অফিসার, শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে আসেন এবং বিজিবি’র সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন ।

পরে রাত পনে ৭টার দিকে এলাকার সকল সদস্যকে শ্রীমঙ্গল সেক্টরে ফেরত নিয়ে আসা হয় । উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সময় স্থানীয় উচশৃংখল জনতা দোকান পাট ও যানবাহনে ভাংচুর এবং রাস্তায় অগ্নি সংযোগ করে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা ও পরিবহন শ্রমিকরা জানায়, ঘটনার সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রীমঙ্গলের হবিগঞ্জ সড়কে ছকিনা সিএনজি শ্রীমঙ্গল ষ্ট্যান্ডের একটি হাই-লাক্স গাড়িকে ওভারটেক করা নিয়ে ড্রাইভারের সাথে বাকবিতন্ডা হয় বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যের। শ্রীমঙ্গল ষ্ট্যান্ডের গাড়িটি শহরের ভানুগাছ সড়কের পানসি রেষ্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে রাখলে ড্রাইভারকে মারধোর করেন বিজিবির সদস্যরা। পাশেই ট্রাক ও কার-লাইটেস ষ্ট্যান্ড থাকায় ড্রাইভাররা জড়ো হয়ে বিজিবির সদস্যদের এমন আচরনে খুব্ধ হয়ে তারা বিজিবির উপর হামলা চালালে আহত হন দুই বিজিবি সদস্য। পরে বিজিবির সদস্যরা ক্যাম্পে গিয়ে ঘটনাটি বললে এক সাথে শতাধিক বিজিবি সদস্য অস্ত্র ও লাঠি নিয়ে ষ্ট্যান্ডে এসে এলোপাতারী ভাবে কার-লাইটেস ও ট্রাক ভাংচুর করে ড্রাইভারদের উপর আক্রমন করে। এসময় যে যেভাবে পারে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে বিজিবি সদস্যরা গুলি করলে শিশুসহ অন্তত ৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। পরে তারা ভানুগাছ রোডের পানসি রেষ্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেন রেষ্টুরেন্টের আসবাবপত্র ও ডেকোরেশন। সেখান থেকে ষ্টেশন রোড হয়ে হবিগঞ্জ রোড ও পরে কলেজ রোডে পথচারীদের লাটিচার্জ করে ভাংচুর করে থানা জামে মসজিদ মার্কেটের বেশ কয়েকটি দোখানপাট। বিজিবি জোয়ানদের লাটিচার্জ থেকে রেহাই পাননি দোখানে বসে থাকা ব্যবসায়ী ও মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ পরে বের হওয়া মুসল্লিরাও।
এদিকে শুক্রবার সকাল থেকেই ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিক শহরে খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে চৌমূহনায় চত্তরে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন। তারা এ ঘটনায় দোষিদের আইনের আওতায় এসে বিচারের মূখোমুখি করে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরন দাবী করেন।
শহরের কলেজ রোডের মুক্তি গ্লাস হাউজের মালিক মোঃ বাচ্ছু মিয়ার ভাই জহির মিয়া বলেন, বিজিবি সদস্যরা তাদের দোখানে ভাংচুর করে দোখান কর্মচারীকে বেধরক লাটিচার্জ করে এতে ওই কর্মচারীর হাত ভেঙ্গে যায়। তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এছাড়া গুলিবিদ্ধ পবিত্র পাল নামের এক ফার্মেসি ব্যবসায়ীকে প্রথমে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার সিলেট রেফার্ড করে, সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। গাড়ি চালক শাহ আলম, ব্যবসায়ী সুকুমার দাশ, বিকাশ চন্দ্র দেব, আবদুন নুর, মো. কদ্দুস, রায়হান উদ্দিন, ইকবাল মিয়া, দুই বিজিবি সদস্য মো. মুমিনুল ইসলাম ও মো. আমজাদকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করার খবর পাওয়া গেছে।
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মেখ লুৎফুর রহমান বলেন, নিরীহ ব্যবসায়ীদের উপর ও ব্যবসা প্রতিষ্টানে হামলার প্রতিবাদে আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করবো। যতক্ষন না পর্যন্ত বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে এর সুষ্ট বিচার করা না হবে।

এর আগে শ্রীমঙ্গলে ৪৬ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার মেজর মাহমুদ সাংবাদিকদেও বলেন, ‘আমাদের একটি গাড়ি ৫৫ বিজিবির এরিয়া থেকে শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের দিকে আসছিল। শহরতলীর কাছাকাছি আসার পর একটি মাইক্রোবাস পেট্রল পাম্প থেকে হঠাৎ আমাদের গাড়ির মুখোমুখি হয়ে অ্যাক্সিডেন্টের পর্যায়ে চলে যায়। তখন ওই মাইক্রোবাসের চালকের লাইসেন্স আছে কিনা জিজ্ঞেস করে জানতে পারি তার কোনো লাইসেন্স নেই। পরে ওই চালককে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু ওই চালক শ্রীমঙ্গল শহরের পানসী রেস্টুরেন্টের সামনে লাইটেসস্ট্যান্ড থেকে বেশ কিছু চালককে নিয়ে এসে বিজিবির গাড়ির ওপর হামলা চালায়। এতে সেক্টর হেডকোয়ার্টারের সিপাহি আমজাদের মাথা ফেটে যায়। বাকি বিজিবি সদস্যদেরও বেধড়ক মারধর করে। সাধারণ মানুষের ওপর হামলা ও গুলি ছোড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা আমি এখন বলতে পারব না। পরবর্তীতে মিডিয়াকে আমরা বিস্তারিত জানাব।
তবে শ্রীমঙ্গল লাইটেস ও কার পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ময়না মিয়া বিজিবির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, বিজিবি একটি গাড়ি ওভারটেক করা নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

Check Also

সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে দুবলার চরে গেলেন ৪০১জন পূণ্যার্থী

উপকূলীয় অঞ্চল (শ্যামনগর): পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে অনুমতি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে রাস মেলায় গেছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।