ক্রাইমবার্তা ডেস্কুিরপোট: আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের তিন বছর পূর্তি আজ। এ সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুত্তি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন দেশের ভেতর-বাইরে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে জনশক্তি রফতানির বাজার উন্মুক্ত এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের আশানুরূপ অগ্রগতিও সবার দৃষ্টি কেড়েছে। আর বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও উল্লেখ করার মতো।
তবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে এসব সাফল্য অনেকাংশেই ম্লান হয়েছে। রাজধানীর হলি আর্টিজান বেকারিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা, বিচারবহির্ভূত ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড, গুম হওয়ার ঘটনা, বিরোধীদের দমনে একের পর এক মামলা-হামলা ও সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহারের ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে।
পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী (যুবলীগ), ভ্রাতৃপ্রতিম (ছাত্রলীগ) সংগঠনের কতিপয় নেতাকর্মীর টেন্ডার ও চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাস এবং নিজেদের মধ্যে কোন্দলের ঘটনাও ক্ষমতাসীনদের প্রায় সময়েই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
এছাড়া কখনও কখনও বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া, বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি এবং খুনাখুনির ঘটনাও বেশ ম্লান করেছে সরকারের নানা অর্জন।
বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দাবি করে আসছে, অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ঊর্ধ্বমুখী। তবে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি গর্তে পড়ে আছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টার পরও বড় ধরনের সুফল আসছে না।’
বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দায় শ্লথ করে দিয়েছে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে। চিহ্নিত কয়েকটি প্রতিবন্ধকতার কারণে মন্দাভাব কাটছে না বিনিয়োগের। সরকারের এই তিন বছরে পদ্মা সেতু ছাড়া দৃশ্যমান কোনো বিনিয়োগ নেই। যেটুকু বেড়েছে তার হিসাব সীমাবদ্ধ রয়েছে কাগজে-কলমে। ফলে কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়নি। পাশাপাশি বিনিয়োগের গতি না থাকায় ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। এ পরিস্থিতির সঙ্গে যোগ হয়েছে রেমিটেন্সে ধস, দুর্বল অবকাঠামো, নিন্মমানের ব্যবসার পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জন কঠিন হবে। এমনকি এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংমের ওপরে যাবে না বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিনিয়োগ মন্দা ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্র অর্জিত হবে না বলে মন্তব্য করা হয় এ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রতিবেদনে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না পর্যাপ্ত জমি এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের অনিশ্চয়তার কারণে। নতুন শিল্প স্থাপনে গ্যাস ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও ঋণের সুদের হার কিছুটা কমলেও এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে আসেনি।
আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত এবং নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মৌলিক প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সিভিল সমাজসহ দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, গত তিন বছরে প্রকৃত অর্থে কোনো ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। বরং এ দীর্ঘ সময়জুড়ে দেশে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করেছে। থেমে থেমে চলেছে জঙ্গিবাদী তৎপরতা।
সময়ে সময়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে বিভিন্ন দেশ। কেউ কেউ এ দেশ থেকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়েও নেয়। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট টিম তাদের নির্ধারিত খেলা বাতিল করে। পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধিচর্চার ওপর আঘাত রুখতে না পারাও ছিল সরকারের এক ধরনের ব্যর্থতা।
একটির পর একটি হত্যাকাণ্ড বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারদের মধ্যে চরম আতংক সৃষ্টি করে। ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের জেরে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির সহাবস্থান সম্ভব না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ গত তিন বছরে অনেক অগ্রগতি সাধন করেছে। তবে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকাণ্ডে জনগণের নিরাপত্তা অসুবিধার মধ্যে পড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। সভ্য জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে এসব জায়গায় উন্নতি করতে হবে।’
দেশে-বিদেশে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৫৩ জন সংসদ সদস্য। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ওই বছর ১২ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো একতরফা নির্বাচন হওয়ায় তীব্র হতাশা ব্যক্ত করেছিল। তবে প্রতিবেশী ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে সমর্থন দিয়েছে।
ভারত বলেছিল, এ নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বাধ্যতামূলক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে দেশে ব্যাপক সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। অবশ্য সরকার ওই রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবেলা করতে সমর্থ হওয়ায় এখন আর পশ্চিমা দেশগুলো এ নির্বাচন নিয়ে তেমন সমালোচনামুখর নয়। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো এখন আগামী নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রতি জোরালো আহ্বান রাখছে।
২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর প্রথম বছর অনিশ্চয়তার নানা দোলাচালে আওয়ামী লীগ ছিল গতিহারা। বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলন ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বেশ চাপের মুখে পড়েছিল সরকার। তবে সেই পরিস্থিতি সামলে তিন বছর পূর্তিতে আওয়ামী লীগ সরকার এখন অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ রেখেই সরকার তৃতীয় বছর শুরু করে। আর তিন বছর শেষে এসে শুরু হয় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ইতিমধ্যে এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : তৃতীয় বছর ২০১৬তে এসে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড বেশ আলোচনায় আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কুমিল্লায় সোহাগী জাহান তনু হত্যা, চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যা এবং তিতুমীর কলেজের ছাত্রী আফসানা হত্যা। এসব হত্যার তদন্তের অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত আশানুরূপ না হওয়ায় সমালোচিত হচ্ছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
গত ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ভেতরে পাওয়া যায় সোহাগী জাহান তনুর লাশ। তাকে ধর্ষণ করে হত্যার অভিযোগ ওঠে। গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোডে সন্তানদের সামনেই কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে। এ মৃত্যু নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। ১৬ আগস্ট তিতুমীর কলেজের ছাত্রী আফসানাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার জন্য দায়ী করা হয় ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা রবিনকে।
এ ছাড়া ২০১৫-এর প্রথম থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বিদেশী নাগরিক, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার ধর্মযাজক রয়েছেন।
সর্বশেষ গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা চালিয়ে দেশী-বিদেশী ২০ নাগরিককে খুন করা হয়। যদিও সেখানে আটকে থাকা জিম্মিদের অনেককেই সরকার দক্ষতার সঙ্গে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। এরপর নানা অভিযানে জঙ্গিদের হত্যা করা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরা পড়ে অনেক জঙ্গি। জঙ্গি সমস্যার সমাধান হলেও পরে সরকার সমালোচনায় পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম নিয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অনেকেই গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
গত বছর দেশের দুটি স্থানে বড় ধরনের সংখ্যালঘু হামলা হয়। একটি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে অপরটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে। অভিযোগ ওঠে, গত ৬ ও ৭ নভেম্বর চিনিকলের জায়গা দখল নিয়ে সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেয় পুলিশ। এ ছাড়া গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৫৩৫ জন। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ১৭২ জন, ২০১৫ সালে ১৮৫ জন ও ২০১৬ সালে ১৭৫ জন। একই সময়ে গুমের শিকার হন ১৯৫ জন। এদের মধ্যে ২০১৪ সালে ৩৯, ২০১৫ সালে ৬৬ ও বিদায়ী বছরে ৯০ জন। এ ছাড়া গত তিন বছরে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলজনিত সংঘর্ষে ১৪৬ জন নিহত হয়েছেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি : সরকার বিরোধীদের অভিযোগ, গত তিন বছরে বিরোধী দল এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোও তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে। তিন বছরের অনেক সময়েই মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করার মতো সাংবিধানিক কোনো অধিকারই দেয়া হয়নি। যখন দলটি অধিকার আদায়ের চেষ্টা করেছে তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, মামলা-হামলা করে অনেকটা কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে তাদের।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও মামলার হাত থেকে রেহাই পাননি। বিএনপির দাবি, তিন বছরে প্রায় ২০ হাজার মামলায় কয়েক লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। শুধু বিরোধী দল নয়, গত তিন বছরে ভিন্নমত দমনেরও নানা ঘটনা লক্ষ করা গেছে। সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার কারণেও বিভিন্ন পেশাজীবীকে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই তাদের হয়রানি করা হয়েছে। এতে প্রকৃত গণতন্ত্র ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সংসদের বাইরে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে শুরু থেকেই কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ ওঠে। জনগণের কোনো দাবি নিয়ে বিএনপি মাঠে নামতে পারেনি। নানা অজুহাত দেখিয়ে গত তিন বছরে তাদের সাতটি সমাবেশ করতে দেয়নি ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে সমাবেশ করাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে চলে সহিংসতা। তিন মাসের সহিংসতার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু তার পরও মাঠে নামতে পারেনি বিএনপি। তিন বছরের মধ্যে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নানা শর্তে একটি সমাবেশ করতে দেয়া হয় বিএনপিকে। এরপর আর তাদের মাঠে নামতে দেয়া হয়নি।
৭ নভেম্বর উপলক্ষে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও পরে নয়া পল্টনে সমাবেশের অনুমতি চাইলেও সরকার তা দেয়নি। সর্বশেষ ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে ৭ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি চায় বিএনপি। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তা আমলেই নেয়নি। অথচ একই মাঠে ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি এবং মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সমাবেশ করে।
বিরোধীদের মাঠে নামতে না দেয়ার পাশাপাশি বিগত তিন বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনেও দেখা যায় একতরফা আধিপত্য। বিনাভোটেই নির্বাচিত হন শত শত স্থানীয় প্রতিনিধি। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে জনগণের শাসন।
তিন বছরে ঢাকার দুই, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছাড়া সব নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, ব্যাপক সহিংস ঘটনায় কয়েকশ’ মানুষের প্রাণহানি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
২০১৬ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ছয় ধাপে সোয়া চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অন্তত ১৩২ জনের মৃত্যু ও ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বোচ্চ ২০৭ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ডও সৃষ্টি হয় এ নির্বাচনে। পরে অক্টোবর পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনেও ওই সব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এর আগে পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে ভোটের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের প্রার্থী হতে বাধা দেয়া, ভোটার ও প্রার্থীদের মারধর করাসহ নির্বাচনী অনিয়মের কারণে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে ছিল সরকার।
পশ্চিমাদের আস্থা ফেরানোর চেষ্টা : পাঁচই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে অনেক এমপি বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাগোষ্ঠী কড়া সমালোচনা করেছিল। এই সরকারের শুরুর দিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে এক বৈরী সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্য সরকার প্রতিবেশী ও পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিদেশীদের আস্থায় আনতে সরকারের প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে তাই সরকারকে ছাড় দিতে হয়েছে। তার একটা বড় দৃষ্টান্ত হল, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা।
পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক লবিং করতে হয়েছে সমর্থন পেতে। তবে প্রথম দিকে আমেরিকা ও ইউরোপ যেভাবে সরকারের প্রতি সমালোচনামুখর ছিল, এখন সেই পরিস্থিতি নেই। প্রতিবেশী ভারত এই সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে। পশ্চিমাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে চীন বর্তমান সরকারের সঙ্গে জোরালোভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করে দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত সম্পর্কে উন্নীত করেন। ওই সময়ে সই হয় প্রায় ২৭টি চুক্তি।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বলেন, ‘জাতীয় সংসদে বেশির ভাগ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ সমালোচনা করেছে। তার বিপরীতে ভারত ও চীন মেনে নিয়েছে। এখন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ সরকারকে মেনে নিয়েছে। এটা ঠিক, গণতান্ত্রিক চর্চা ও মানবাধিকারের প্রশ্নে ঘাটতি আছে। বিশেষ করে মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার অবকাঠামো উন্নয়নে ভালো করেছে। গণতন্ত্রের ঘাটতির মধ্যেও বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্য ঘাটতি পূরণ প্রভৃতি খাতে ভালো করেছে। সবচেয়ে বড় কথা সরকারে ধারাবাহিকতা থাকায় মেগাপ্রকল্প সম্পন্ন করতে পেরেছে। এখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সরকারকে নজর দিতে হবে।’ যুগান্তর