ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট: ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই সরকার নৈতিকভাবে দুর্বল। জনগণের চিন্তা না করে গত তিন বছর নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিল ক্ষমতাসীনরা। বক্তৃতানির্ভর কিছু উন্নয়নের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দেশে টেকসই কোনো উন্নয়ন হয়নি। বিনিয়োগ না থাকায় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে।
আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণের মহোৎসব চলছে। জবাবদিহিতা ও সুশাসন না থাকায় ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ আর্থিক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। সমানতালে চলেছে দখলদারিত্ব। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় সর্বক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে অশান্তি আর অস্থিরতা’-বর্তমান সরকারের তিন বছরকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা ও দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা।
যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, সরকারের তিন বছরে মামলা-হামলা ও নির্যাতনের মাধ্যমে বিরোধী দলের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলেছে। সভা-সমাবেশের মতো সাংবিধানিক অধিকার থেকে বিরোধীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশে বিরাজনীতিকরণের একটা প্রাণপন্ত চেষ্টা চলেছে। গণতন্ত্রহীনতার কারণে সর্বক্ষেত্রে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা দিন দিন বাড়ছে। এভাবে চললে ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে।
গণতন্ত্রহীনতার এ সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এ জন্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, গত তিন বছরে সরকারের সাফল্য বলতে মানবাধিকার হরণ, দুর্নীতি, হত্যা, গুম, খুন আর বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে দেখা গেছে। জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলে জনগণ দেখলেই তাদের মধ্যে একটা আতংক কাজ করেছে। সে জন্য বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি। তাদের প্রধান শক্তি হচ্ছে পুলিশ, বিজিবি আর র্যাব। যে দলটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে; সেই আওয়ামী লীগকে র্যাব-পুলিশ, বিজিবির সহায়তায় দেশ চালাতে হয়- এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘দু-একটি ফ্লাইওভার দেখিয়ে তারা উন্নয়নের কথা বলছে। তারা উন্নয়ন মানেই গণতন্ত্র এমনটা বলে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু উন্নয়ন মানেই গণতন্ত্র নয়।’
তিনি বলেন, তিন বছরে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন সংসদ সদস্য নিজ বাড়িতে খুন হওয়ার পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কী; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষমতা ধরে রাখার কাজে আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করার জন্যই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগে ভাটা পড়ায় কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হবে না বলে বিশ্ব সংস্থাগুলোও আগাম শংকার কথা জানাচ্ছে। তারপরও সরকারের মুখে উন্নয়নের জোয়ার ছাড়া কিছুই শোনা যায় না।
তিনি বলেন, যেখানে গণতন্ত্র থাকে না সেখানে উগ্রজঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেশ সেদিকেই যাচ্ছে।
ফখরুল বলেন, গত তিন বছরে সরকারের মধ্যে কোনো জবাবদিহিতা দেখা যায়নি। জবাবদিহিতা না থাকায় ক্ষমতাসীনরা ব্যাংক, শেয়ারবাজারসহ সব জায়গায় লুটপাট করেছে। দলীয়করণের মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। এখন সব জায়গায়ই অস্থিরতা। এসব থেকে উত্তরণে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিএনপি সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
সরকারের তিন বছরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ১৫৩ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর এ সরকারকে নির্বাচিত সরকার বলা যাবে না। কারণ সরকার গঠনের জন্য ১৫৩ আসন যথেষ্ট। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি বলে গত তিন বছরে সরকারের সেই দুর্বলতা দেখা গেছে। জনগণের প্রতি তাদের ভয় লক্ষ্য করা গেছে। তিন বছরে যেসব নির্বাচন হয়েছে কোনোটাতেই জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে বাক্সবন্দি করতে তিন বছরে তারা ব্যস্ত ছিল। বিরাজনীতিকরণে অব্যাহত চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ জন্য বিরোধী দলকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। মিথ্যা মামলা ও নির্যাতন করে তাদের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। গত তিন বছরে জনগণের কাছে এ সরকার স্বৈরাচারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই সরকার জনগণের স্বার্থকে তোয়াক্কা করছে না। বারবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। সর্বক্ষেত্রে ভ্যাট বসিয়ে জনগণের পকেটের টাকা লুট করা হয়েছে। বক্তৃতানির্ভর কিছু উন্নয়ন হয়েছে; কিন্তু দেশে প্রকৃত কোনো উন্নয়ন হয়নি। সরকার মুখে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরলেও বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের প্রকৃত আর্থিক পরিস্থিতি তুলে ধরছে। বিনিয়োগ না থাকায় কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে না বলে বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে শংকার কথা জানিয়েছে; যা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
মোশাররফ হোসেন বলেন, গণতন্ত্র না থাকলে টেকসই উন্নয়ন হয় না; যা আমরা লক্ষ্য করছি। দেশে গণতন্ত্র না থাকায় সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের বিকাশ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। সামাজিক, ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বক্ষেত্রে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। এ থেকে উত্তরণে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের তিন বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভয়ংকর অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ অস্থির ছিল। তিন বছরে বিভিন্ন স্তরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছেন। গণতন্ত্র পুরোপুরি কার্যকর না থাকায় সামাজিক ক্ষেত্রে অশান্তি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তিন বছরে দেশে বিরাজনীতিকরণের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও ধরপাকড় বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। হিংসা-প্রতিহিংসা বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের চিন্তা-ভাবনা ধারণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের মধ্যে জবাবদিহিতা ও সুশাসনের অভাব দেখা গেছে। গণতান্ত্রিক অবস্থায় সুশাসন অপরিহার্য হলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত।