মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। জানা যায়, চলতি বছর মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার কোটি টাকা থাকবে আরএডিপির হিসাবের বাইরে। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব ঋণ হিসাবে থাকবে এ টাকা। এই হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা একেবারেই বাদ যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে চূড়ান্ত করার সময় পর্যন্ত অল্প কিছু বরাদ্দ বাড়তেও পারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেট বড় করে দেখানোর জন্যই প্রতিবছর বৈদেশিক সহায়তা বেশি দেখানো হয়। এটা এক ধরনের শুভংকরের ফাঁকি ছাড়া কিছুই না।
তবে ব্যবহারের জটিলতাই যে বৈদেশিক অর্থ বরাদ্দ কমার কারণ তা মানতে নারাজ ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটা মূলত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের সমস্যা। কেন না, সব সময় অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। জনতুষ্টির জন্য বাজেটে এটা করা হয়। পরে মাঝ পথে এসে আবার কমানোটা এক ধরনের ট্রেডিশন হয়ে গেছে। ফলে বিশ্বাযোগ্যতা থাকে না। কেন না, যারা বাজেট করেন তারাই বিশ্বাস করেন না যে এই অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করা যাবে। সুতরাং যারা বাস্তবায়ন করে তারাও সিরিয়াসলি নেন না।
এ প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম যুগান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ একটি কারণ হতে পারে। তবে, বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা রয়েছে। যেমন ডোনারদের অনেক কন্ডিশন থাকে। সেগুলো পূরণ করতে সময় চলে যায়। তাছাড়া চলতি অর্থবছর বৈদেশিক অর্থ বাদ দেয়ার কারণ হচ্ছে বড় বড় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে গতি না আসা। এর মধ্যে কোনো কোনোটির বাস্তবায়ন কাজ এখনও শুরুই হয়নি।
ইআরডি সূত্র জানায়, বুধবার পর্যন্ত সংশোধিত এডিপিতে ৩২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। পরে বিদ্যুৎ খাতের ৬টি প্রকল্পে, যোগাযোগ খাতের একটি, জনপ্রশাসন খাতের একটি এবং পানিসম্পদ খাতে একটি নতুন প্রকল্পে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার প্রাথমিক হিসাবে মোট ৩৩ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ বাদ যাচ্ছে বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকার, যোগাযোগ, রেল ও পানিসম্পদ খাত থেকে। তবে কোন মন্ত্রণালয় থেকে কত টাকা কমছে সেটি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি ইআরডি। সংস্থাটি জানায়, গত অর্থবছরের (২০১৫-১৬) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত এডিপিতে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাদ দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। তার আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। পরে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ দাঁড়িয়েছিল ২৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা অর্থ ব্যবহার করতে না পারার কারণ সম্পর্কে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বৈদেশিক পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, অনাপত্তি প্রাপ্তিতে দেরি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঠিক সময় সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা না দেয়া, ক্রয় ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের অভাব প্রভৃতি কারণে যথাযথভাবে বৈদেশিক অর্থের ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এছাড়া ক্রয় প্যাকেজের প্রক্রিয়াকরণে পুনঃদরপত্র আহ্বান, আইন মন্ত্রণালয় থেকে ভেটিং প্রাপ্তিতে বিলম্ব এবং ঠিকাদারের কাজে শ্লথ গতিও অর্থ ব্যবহার করতে না পারার কারণ।
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায় কিছু ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত দীর্ঘ সূত্রতা রয়েছে। কিন্তু সেটি মেনে নিয়েই ঋণ নেয়া হয়। প্রকল্প সংশোধনের সময়ও উন্নয়ন সহযোগীদের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সুতরাং এগুলো বৃহত্তর পরিসরে এডিপিতে ওই ভাবে প্রভাব পরার কথা নয়।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, বৈদেশিক অর্থের অনেক নিয়ম-কানুন থাকে। যেগেুলো মেনে কাজ করতে গেলে কিছুটা বিলম্ব হয়। তাছাড়া তাদের পরামর্শক নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের অভাবতো আছেই। তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ সূত্র জানায়, সংস্থাটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত এডিপির আওতায় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো মোট ব্যয় করতে পেরেছে ৩৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একই সময়ে অর্থাৎ ছয় মাসে এডিপি থেকে মোট ব্যয় হয়েছিল ২৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ব্যয় হয়েছিল ৬ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের একই সময়ে এডিপি থেকে মোট ব্যয় হয় ২৩ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৭ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এডিপিতে ব্যয় হয়েছিল ১৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৫ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এডিপিতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা থেকে ব্যয় হয়েছিল ৫ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। অপরদিকে ইআরডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড় কম হয়েছে। এ সময়ে (জুলাই-নভেম্বর) ছাড় হয়েছে ৯০ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এর মধ্যে ঋণ ৮০ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার এবং অনুদান ৯ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ে মোট অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর মধ্যে ঋণ ছিল ৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৪০ হাজার এবং অনুদান ১৬ কোটি ১১ লাখ ২০ হাজার ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরের চেয়ে এ অর্থবছর অর্থছাড় কমেছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে মোট ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার এডিপি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৭০ হাজার ৭০০ কোটি, বৈদেশিক সহায়তা ৪০ হাজার কোটি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন ১২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আর এডিপি তৈরির জন্য ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছিল ইআরডি।যুগান্তর।