ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:
বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণী মুনিরা হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী আমেরিকার মুখ। মুনিরার মুখে মার্কিন পতাকা দিয়ে বানানো হিজাব। সেই ছবি থেকে বানানো পোস্টার এখন ট্রাম্প বিরোধীদের হাতে। ছবিটি ভাইরাল হয়ে গেছে অনলাইন মাধ্যমেও। কোন মুখ বেশি আমেরিকান? ট্রাম্পের মুখ, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা মোড়ানো অশ্বেতাঙ্গ তরুণীর মুখ?
গত শনিবার দুনিয়াজুড়ে ট্রাম্প বিরোধী লাখো নারীর মিছিলে মুনিরার পোস্টারই উত্তরটা দিয়ে দিয়েছে। পোস্টারটায় লাল-নীলে আঁকা মুনিরার মুখের নিচে লেখা: উই আর দি পিপল, গ্রেটার দ্যান ফিয়ার (আমরাই জনগণ, ভয়ের চেয়েও বড়)।
আমেরিকা কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে পৃথিবীতে? দুনিয়াজুড়ে ট্রাম্প বিরোধী বিক্ষোভ এই প্রশ্নের ফয়সালা চায়। এক দিকে মুনিরার মুখ, অন্য দিকে ট্রাম্পের মুখ। একটি মুখ দম্ভের, অন্যটি স্পর্ধার। একটি মুখ ঘৃণার, অন্যটি সরলতার। একটি মুখ বর্ণবাদের, অন্যটি সর্বজনের। একটি মুখ সাম্রাজ্যের, অন্যটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের।
ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রতিবাদী পোস্টার-প্ল্যাকার্ড নেওয়া নিষেধ। তাই এক বুদ্ধি করা হলো। চমকটা এল সক্কালবেলাতেই। দিনের পত্রিকা হাতে নিয়ে অনেকেই দেখল, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো বড় বড় পত্রিকায় ট্রাম্প বিরোধী পূর্ণ পৃষ্ঠা পোস্টার ছাপা হয়েছে। কৌশলটা কাজে লাগল। দূর-দূরান্তের প্রতিবাদীরাও হাতে রাখার, দেয়ালে লাগানোর কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার জিনিস পেয়ে গেলেন। নারীদের মিছিলগুলো পেয়ে গেল জোরালো এক অভিব্যক্তি। পোস্টারগুলো বিজ্ঞাপন হিসেবে ছাপানোর খরচ ওঠানো হয় গণচাঁদার ভিত্তিতে। পোস্টার করা হয়েছিল তিনটি। একটি মুসলিম মুনিরার, অন্য দুটি এক লাতিনো তরুণী ও কৃষ্ণাঙ্গ বালকের। কিন্তু মানুষের মনে গেঁথে গেল মুনিরার শান্ত কিন্তু আত্মবিশ্বাসী মুখ। ট্রাম্প যে মুসলমানদের সন্দেহের তালিকায় রাখতে চান, এক মুসলিম তরুণীকে প্রতিবাদের প্রতীক করে তারই জবাব দিয়েছে অবর্ণবাদী উদার আমেরিকা।
পোস্টারে উঠে আসা ছবিটি তুলেছিল মুনিরার বন্ধু রিদওয়ান আদহামি। মুনিরা ও রিদওয়ান ৯ / ১১-এর ঘটনাস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটি তুলেছিলেন ১০ বছর আগে। মুনিরার ভাষায়, ‘এই ছবি কোনো কিছুর বিরুদ্ধে না; বরং এটা অন্তর্ভুক্তির পক্ষে। এটা বলছে, তোমার মতো আমিও একজন আমেরিকান।’ রিদওয়ান ১০ বছর পর এই ছবির নাম দিয়েছিলেন ‘আই অ্যাম আমেরিকা’। দশ বছর পর সেই ছবি থেকে যে পোস্টার আঁকা হলো, তার নাম ‘উই আর দি পিপল’। ইতিহাস এমনই লীলাময়।
মুনিরা বাংলাদেশি-আমেরিকান এবং মুনিরা মুসলিম। এ পোস্টার বলছে, জনগণ মানে কোনো একক পরিচয় নয়। জনগণের মধ্যে বিবিধ পরিচয় থাকবে। এক জনগণের মধ্যে থাকবে বিভিন্ন জাতির, ভাষার, ধর্মের, রঙের ও মতবাদের মানুষ। এটাই আজকের বিশ্বের বাস্তবতা। বহুত্ববাদী সমাজ ছাড়া কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের পক্ষে গণতান্ত্রিক, মানবিক ও শান্তিবাদী হওয়া কঠিন। অপরকে সম্মান জানানোই শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। যাকে আমি প্রতিবেশী ভাবতে পারি না, তার সঙ্গে এক রাষ্ট্র চালানো অসম্ভব। সহনাগরিকতা মানে তাই প্রতিবেশীতাও।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের ইচ্ছা ভিন্ন। তাঁদের আমেরিকা কেবলই শ্বেতাঙ্গের। তিনি শুধু মেক্সিকো সীমান্তেই দেয়াল তুলতে চান না, তিনি চান সাদা ও কালোর মধ্যে, খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের মধ্যে, বিষমকামী ও সমকামীর মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলতে। মুনিরার মতো অশ্বেতাঙ্গ, অখ্রিষ্টান, অপশ্চিমা মানুষদের মুখ আমেরিকার প্রতিচ্ছবি হোক, ট্রাম্প তা চান না। অথচ একজন কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা আট বছরের জন্য দেশটির প্রতীক হয়ে ছিলেন।
কিন্তু এখনকার বিরোধ ওবামা বনাম ট্রাম্পের নয়। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর বিষয়টা আর হিলারি বনাম ট্রাম্পের মধ্যেও আটকে নেই। এটা দুই বীরের দ্বন্দ্ব নয়। এ দ্বন্দ্ব সাধারণ জনগণ বনাম দাপুটে শাসকের। এই লড়াই অনামা মানুষদের সঙ্গে ধনকুবের প্রেসিডেন্টের। এই বিতর্ক আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রতিবাদের প্রতীক তাই হিলারি বা ওবামার থেকে ছবি ধার করা হয়নি। নেওয়া হয়েছে মুনিরার মতো অতিসাধারণ একজনের মুখচ্ছবি। ট্রাম্প বিরোধীরা পোস্টারে ও স্লোগানে তুলে ধরেছেন অন্যদের মুখ, যাঁদের অস্বীকার করতে চায় বর্ণবাদী আমেরিকা। আর পোস্টারগুলো এঁকেছেন এমন এক শিল্পী, যিনি ২০০৮ সালে বারাক ওবামার বিখ্যাত ‘হোপ’ পোস্টারটি এঁকেছিলেন। তাঁর নাম শেপার্ড ফেইরে। সে সময় অনেকের কাছে ফেইরের আঁকা পোস্টারটিকে মনে হয়েছিল ওবামার জাগানো আশাবাদের প্রতীক। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকান পতাকার হিজাবের ছবি খুবই শক্তিশালী। কারণ এটা আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তিগত নীতি।’
মুনিরাও অকপট, ‘আমি আমেরিকান, আমি মুসলিম এবং আমি এই দুই পরিচয় নিয়েই গর্বিত।’ মুনিরার এই দাবি সর্বজনীন। যেকোনো দেশে, যেকোনো সমাজে সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রথম ধাপ তার পরিচয়ের স্বীকৃতি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের ধর্ম-বর্ণ-ভাষা যা-ই থাকুক, রাষ্ট্রের কাছে সবাই সমান নাগরিক। সবারই মর্যাদা ও অধিকার সমান। শেপারের আরেকটি পোস্টারে এক কৃষ্ণাঙ্গ বালকের ছবির নিচে তাই লেখা: ‘মর্যাদা বাঁচাও’।
বাংলাদেশে আমরা বাঙালি আছি, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-আদিবাসী আছি-এসব পরিচয়ের মিলিত রূপই কিন্তু বাংলাদেশি পরিচয়। এই বাংলাদেশিয়তা এই ভূখণ্ডের সব জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়কে যদি ধারণ না করে তবে বাংলাদেশে সংহতি আসবে না। বাংলাদেশি মুনিরা আমেরিকার নারী জাগরণে যে বার্তা দিতে পেরেছেন, সেই বার্তা তাঁর মাতৃভূমির মানুষেরা শুনছি কি? মুনিরা বলেছেন, ‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক, আমেরিকায় এখনো এমন মানুষ আছে, যারা মনে করে আমেরিকা হলো ভিন্ন উৎস থেকে আসা মানুষদের দূরে রাখার দেশ। আমার কাছে আমেরিকার গোড়ার মূল্যবোধ মোটেই এটা নয়।’
উল্লেখ্য, শেপার কিন্তু হিলারির পোস্টার আঁকতে রাজি হননি আর মুনিরাও কিন্তু হিজাবধারী নারী নন। তাঁরা উভয়ে মিলে যা করেছেন তার নাম সংহতি। যার পরিচয় আক্রান্ত, যে জনগোষ্ঠী ভীত, তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতিকেই প্রতিবাদের প্রতীক করেছেন। এর মধ্যে বার্তাটি কিন্তু পরিষ্কার, মানুষের পোশাক, ধর্ম, সংস্কৃতি যার যার, কিন্তু অধিকার সবার। পরিচয় ছাড়া মানুষ হয় না, নিপীড়িতকে তার পরিচয়সহই মেনে নিতে হবে।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, আমেরিকার স্বরাষ্ট্রনীতি ঠিক হয় তার পররাষ্ট্রনীতির নিরিখে। যে আমেরিকা মুসলিম দেশগুলোতে যুদ্ধ করে, সে আমেরিকার স্বরাষ্ট্রনীতিতে মুসলিমদের শত্রু বলেই দাগানো হবে। ট্রাম্প আমেরিকান মুসলিমদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। রোমান সাম্রাজ্যেও সব নাগরিকের সমান অধিকার ছিল না, হিটলারের জার্মানিতেও না। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রিপাবলিক হিসেবে, এম্পায়ার হিসেবে নয়। ট্রাম্প বনাম মুনিরাদের লড়াই থেকেই ঠিক হবে, আমেরিকা সত্যিকার রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র হবে, নাকি হয়ে উঠবে আরও আগ্রাসী এক সাম্রাজ্য?