কুসংস্কার তাড়ানোর প্রকল্পই কু-আচ্ছন্ন

ক্রাইমবার্তা রিপোট:বয়োসন্ধি ও যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি এবং লিঙ্গভেদে পারস্পরিক সম্মানবোধের উদয় ও ছেলেমেয়ের বিভাজন-ভাবনার কুসংস্কার থেকে ১০ বছর থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মুক্ত করার লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্প ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু’ নিজেই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে ব্রেক কষে বসেছে। খোদ শিক্ষকরাই শ্রেণিকক্ষে যৌন বিষয়াদি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে বিব্রতবোধ করছেন।3

উপরন্তু দুবছর মেয়াদি এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষে সম্পন্ন হয়েছে সবে চারআনা; বারোআনাই বাকি। এ চারআনা নিয়েও রয়েছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। তদুপরি বাস্তব জ্ঞানার্জনের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ-বিলাসিতা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।

কী কৌশলের ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারিত হবে, সেই ছক তৈরি এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতেই ফুরিয়ে গেছে প্রকল্পের মেয়াদকালের পুরো দুবছর। এ সময়কালে ব্যয় হয়েছে পুরো প্রকল্পের মাত্র ২৫ শতাংশ অর্থ। এ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুবছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বের অনেক দেশে এমন প্রকল্প রয়েছে। ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ডের (ইউএনএফপিএ) আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় গৃহীত এ প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৭৮ কোটি ৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। পাইলট প্রকল্পে পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল ও ঢাকা মহানগরের ২৯০টি হাইস্কুল ও ৬০টি মাদ্রাসাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লৈঙ্গিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা সৃষ্টিতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কারিকুলামের আদলে এ দেশেও শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা হয় কারিকুলাম। সেই কারিকুলাম আমাদের স্বকীয় আদলে তৈরি ও অনুমোদনে জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সময় নেয় দেড় বছর।

কুসংস্কার-তাড়ানিয়া ও যৌন সচেতনতা সৃষ্টিমূলক এ প্রকল্পের অধীনে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্পভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি কুয়াকাটা বঙ্গবন্ধু হাইস্কুল। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের স্কুলের দুজন শিক্ষিকা ও একজন শিক্ষককে এ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শ্রেণিকক্ষে যৌন বিষয়ে পাঠদানে বিব্রতবোধ করেন।

প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তাতে সম্মানীভাতা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন পটুয়াখালীর খেপুপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি মনে করেন, এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় সঠিকভাবে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে না। প্রবীণ এই শিক্ষকের কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ৫ থেকে ৬ বার দুর্নীতিতে প্রথম হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ প্রকল্পও দুর্নীতির বাইরে নয়।

অবশ্য প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক ও মাউশির প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর হোসেন। আর প্রকল্পের কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তাই প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আমাদের অধিকাংশ সময় শেষ হয়ে গেছে। মাঠপর্যায়ে মেয়াদকালের শেষ দুই মাস কাজ করতে পেরেছি।

এ দুই মাসে শিক্ষার্থীদের মানসজগতে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি বলেই স্বীকার করেন তিনি। ড. জাহাঙ্গীর হোসেন যোগ করেন, সামাজিক অপচিন্তা পরিবর্তনে প্রয়োজন সময়। তাই প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। সেটি মঞ্জুর হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের তথ্যে পাওয়া যায়, প্রকল্পভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি থেকে ৪ জন করে মোট ১৪০০ শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পাঁচ দিনের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে অর্ধদিবস।

প্রকল্পের অর্থে ২০১৫ সালে রোকেয়া দিবস ও ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। প্রকল্প এলাকার জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে সভাও করেছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পের আওতায় একটি করে কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে ৩৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কম্পিউটার ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন প্রকল্পভুক্ত শিক্ষকরা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দেশ ভিয়েতনাম থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মাউশির মহাপরিচালকসহ প্রকল্পের কতিপয় কর্মকর্তা প্রকল্পের অর্থে সে দেশে ভ্রমণও করে এসেছেন।

জেনারেশন ব্রেক থ্রু

ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধসংক্রান্ত তথ্যপ্রবাহে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া বয়োসন্ধিকালে আচরণগত পরিবর্তন ও করণীয়; লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক আচরণ, পারস্পরিক সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলা; লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ; ছেলেমেয়ের মধ্যে বিভাজন ভাবনা, যৌন সচেতনতা, শারীরিক পরিবর্তনের সমাধান ও সুপরামর্শ, যৌন স্বাস্থ্য প্রভৃতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা যেন সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারে সে জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়।

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।