ক্রাইমবার্তা রিপোট: জালটাকার ভয়ঙ্কর জাল ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। দেশের অর্থনীতির জন্য এ এক মরণব্যাধি। এর বিরুদ্ধে দফায় দফায় চলছে অভিযান, উদ্ধার হচ্ছে নকল টাঁকশাল, মামলা হচ্ছে আদালতে। কিন্তু এরপরও ঠেকানো যাচ্ছে না এর সর্বগ্রাসী বিস্তার। উপরন্তু দেশি চক্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদেশি চক্র, গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ফলে আর্থিক লেনদেন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীÑ কারোই নিস্তার নেই; প্রত্যেকেই আর্থিক ক্ষতি, বিড়ম্বনা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে হয়রানির শিকারও হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিলম্বিত বিচার, সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ঢিলেমি, আইনি ফাঁকফোকরে অভিযুক্তদের মুক্তি, যথার্থ প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবেই দিন দিন ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে জালটাকার কারবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জালটাকা নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন আদালতে ৬ হাজার ৩শ ৭০টি মামলা হয়েছে। মামলার তুলনায় মামলা নিষ্পত্তির হার ১৫ শতাংশেরও কম। এদিকে জালটাকার কারবারিদের অপতৎপরতা ঠেকাতে জালনোট প্রচলন প্রতিরোধসংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির বৈঠক হচ্ছে নিয়মিতই। বৈঠকে মামলাগুলোর কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার নানা সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আদতে কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৫ ডিসেম্বর। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, জালটাকা প্রতিরোধে নতুন জাতীয় জালনোট প্রতিরোধ আইনের একটি চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সেটির এখন যাচাই-বাছাই চলছে। খসড়া আইনে জালনোট প্রস্তুতের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে সাক্ষীর অভাবে অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে; ফিরে যাচ্ছে পুরনো পেশায়। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। সাক্ষীর অভাবে যেন প্রকৃত অপরাধীরা খালাস না পায়, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা আমাদের সময়কে খসড়া আইনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, চলতি মাসেই টাস্কফোর্সের আওতায় একটি মিটিং করা হবে। সেখানে সর্বশেষ পরিমার্জন শেষে নতুন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জালটাকার কারবারিরা ধরা পড়লেও অধিকাংশ সময়ই প্রশাসনিক বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্য তথ্য থেকে দেখা যায়, সাক্ষীর অভাবেও বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে। আমরা নতুন আইন করে এবং জনগণকে সচেতন করে জালটাকার কারবার বন্ধ করতে চেষ্টা করছি। বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং র্যাব ও ডিবি পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে জালনোট তৈরি ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধী ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের একাধিক চক্র জড়িত। পাকিস্তান থেকে আনা বিশেষ ধরনের কাগজে ছাপা হচ্ছে জালটাকা। এসব কাগজ হুবহু আসল টাকা তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজের মতোই। এর সঙ্গে রয়েছে ছাপাখানার উন্নত প্রযুক্তি। এসব চক্রে ক্ষেত্রভেদে জড়িয়ে পড়ছেন অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও। জাল মুদ্রা থেকে উপার্জিত অর্থ মাদক, অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযানে প্রায়ই জালটাকার কারখানা থেকে হাতেনাতে বিপুল পরিমাণে নকল টাকাসহ এ ধরনের অপরাধীরা ধরা পড়লেও বেশিরভাগ অভিযুক্তই খালাস পেয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শাস্তির পাশাপাশি সরকারি কৌঁসুলিদের আরও সুদৃষ্টি দেওয়ার বিষয়ে জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এসব মামলায় সাধারণত রাষ্ট্র বাদী হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারি কৌঁসুলিরাও অনেক সময় অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে দোষীদের রক্ষা করে থাকেন। এদিকে সরকারি কৌঁসুলিদের দাবি, জালনোট ধরার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাদের সাক্ষী করেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলার শুনানি চলাকালে তারা সাক্ষ্য দিতে আসেন না। মামলাতেও অনেক সময় ফাঁকফোকর থেকে যায় বা রাখা হয়। ফলে আসামিরা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আবার চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এ সংক্রান্ত বেশিরভাগ মামলায় সাক্ষীর অভাবে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। অনেক মামলায় আসামিদের স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে এটাও একটা বড় সমস্যা। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু আমাদের সময়কে বলেন, জালটাকা সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে ১২০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নিয়ম থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা সে নিয়ম মানছেন না। এদিকে মামলার সাক্ষীর অনুপস্থিতি, বিলম্বিত চার্জশিট প্রদানসহ নানা কারণে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও জালটাকায় অভিযুক্তদের জামিন ঠেকানো যাচ্ছে না। তবে একাধিক মামলায় অভিযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের বিষয়ে দৃষ্টিগোচর হলে তাদের জামিনের বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। জালটাকা চক্রের ঢাকা উত্তরের প্রধান গাইবান্ধার বাবুল শেখ। থাকেন রাজধানীর ভাটারা থানাধীন ফাহমিন ঢালী কাঁচাবাজার এলাকায়। ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর একই এলাকার নিজ বাসা থেকে একবার তিনি ৩৫ লাখ টাকার জালনোট ও জালনোট তৈরির সরঞ্জামাদিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ডিবি পুলিশের হাতে। এর আগে-পরে রাজধানীর মগবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, চকবাজারসহ ঢাকার বাইরেও বিপুল পরিমাণে জালটাকাসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। ভাটারার অভিযানে বাবুলের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তার সহযোগী ফেরদৌস আলী, লুৎফর রহমান, কবির, ফয়সাল মোল্লা ও মহিউদ্দিন খান। ওই ঘটনায় মামলা হয় ভাটারা থানায়, নম্বর ০১ (১১) ২০১৪। কিন্তু ঘটনার ২ বছর পেরিয়ে গেলেও একজনেরও বিচার শুরু হয়নি। দুই বছর পর অর্থাৎ গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আদালতে বাবুল শেখসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (নম্বর ২১২) দিয়েছে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা। তবে এখনো আদালত থেকে ডাকা হয়নি সাক্ষীদের। গত বৃহস্পতিবার ওই মামলার বাদী ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের (পশ্চিম) এএসআই মো. আবদুল মালেক আমাদের সময়কে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাউকেই সাক্ষী হিসেবে ডাকেননি আদালত।’ সূত্র জানিয়েছে, অভিযুক্ত বাবুল শেখসহ ওই মামলার সব আসামিই এখন জামিনে। তারা ফের মিরপুর, বাড্ডা, ভাটারাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে জালটাকা তৈরির কারখানা গড়ে তুলে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। শুধু বাবুল শেখই নন, নকল টাকা তৈরির সরঞ্জাম ও নোটসহ এ যাবৎ যেসব প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ সদস্যই জামিনে বেরিয়ে এসে ফের অভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। ফলে তাদের অপতৎপরতা অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে বলে অভিমত গোয়েন্দাদের। গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের একটি বাড়ি থেকে ২০ লক্ষাধিক জালটাকা ও জালটাকা তৈরির সরঞ্জামসহ হুমায়ুন কবির, অলি ও তিথি আক্তার নামে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। গ্রেপ্তারদের ছাড়াতে তাদের সহযোগীরা এরই মধ্যে জামিনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে জালনোট সংক্রান্ত মামলা হয় ৫ হাজার ৪৬৮টি। বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ১ হাজার ২৩৪টি মামলা। ২০১৩ সালে জালনোটের মামলা হয় ৩১১টি। নিষ্পত্তি হয় ৯০টি। ২০১৪ সালে ৩৬৮টি মামলার বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় ১১৯টি। ২০১৫ সালে জালনোট সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ছিল ৪১০; সে বছরের ডিসেম্বর শেষে জালনোটের অনিষ্পন্ন মামলার স্থিতি ছিল ৬ হাজার ১৯৫টি। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৩২৭টিতে। সে বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ১২ মাসে এ সংক্রান্তে মামলা হয় ৩৪৪টি। এর বিপরীতে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ১০৬টি মামলা। অর্থাৎ বিচারের অপেক্ষায় এখন পর্যন্ত ঝুলে আছে ৬ হাজার ৩শ ৭০টি জালটাকা সংক্রান্ত মামলা। এগুলোর মধ্যে এক একটি মামলায় বিভিন্ন মানের মুদ্রা রয়েছে। এর বেশিরভাগই জালনোটসহ গ্রেপ্তার করা। কিছু আছে জালনোট তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা।
Check Also
৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …