ক্রাইমবার্তা রিপোট:গভীর রাত। বিটের তালে তালে কেঁপে উঠছে পুরো এলাকা। ডিজে তরুণীর হাতের জাদুতে সাউন্ড স্পিকারে যেন আনন্দের ঝড়। বাজছে একের পর এক হিন্দি, ইংরেজি পপ ও বাংলা গান। ড্যান্স ফ্লোরে মাতাল চেয়ার্সগার্ল। ফ্লাইং কিস দিচ্ছেন। স্বল্প বসনা তরুণীদের সঙ্গে তরুণরাও কম যান না। জড়িয়ে ধরছেন একে-অন্যকে। তা উপভোগ করছেন চারপাশের চেয়ারে বসে থাকা শত শত নারী-পুরুষ। প্রায় সবার হাতেই ড্রিংকস। কারও হাতে বিয়ারের ক্যান, কারও হাতে মদের গ্লাস। ক্যান-গ্লাস হাতে নিয়েই কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন ড্যান্স ফ্লোরে। এই দৃশ্য রাজধানীর রাতের পার্টিগুলোর। তারকা হোটেল, বিভিন্ন রিসোর্ট ও অভিজাত বাসা বাড়িতে প্রায় রাতেই আয়োজন করা হয় এরকম পার্টির। রাজধানী ও আশেপাশের বেশ কয়েক স্থানে কমার্শিয়ালভাবে আয়োজন করা হয় এরকম পার্টি। উত্তরা, তুরাগ, গাজীপুর এলাকায় কমার্শিয়াল পার্টিগুলো বেশি হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার। পার্টিকে কেন্দ্র করে বর্ণিল আয়োজন তুরাগ রিক্রিয়েশন রিসোর্টে। রাজধানীর রূপনগরের বেড়িবাঁধ এলাকা পেরিয়ে বিরুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন এই রিসোর্ট। রিসোর্টকে দুই ভাগে ভাগ করেছে তুরাগ নদী। যে কারণে একটি অংশ ঢাকা মেট্রোপলিটনের রূপনগর থানা এবং অন্য অংশ সাভার থানা এলাকায়। সবুজঘেরা সড়কের পাশে সুদর্শন ফটক। ফটকের ভেতরে এক তলা একটা ঘর। চারপাশে সবুজ। আছে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। বিলাসবহুল বিভিন্ন গাড়ি রাখা সেখানে। সেইসঙ্গে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল। এই অংশের এক পাশে সরু দরজা। দরজার ওপাশে পা রাখতেই চোখে পড়লো অপেক্ষমাণ নৌকার মাঝি। তিনিই পৌঁছে দেবেন রিসোর্টের অন্য অংশে। মাঝি কয়েক মিনিটে তুরাগ নদীর শরীরের ওপর দিয়ে পৌঁছে দিলেন ওই প্রান্তে। সেখানে আরেক ফটক। ফটকের ভেতরে অভ্যর্থনার জন্য সাজানো চেয়ার-টেবিল। চেয়ারগুলোতে বসে আছেন এক তরুণী ও তিন তরুণ। পূর্ব থেকে টিকিট সংগ্রহ করা না থাকলে সেখানে টিকিট সংগ্রহ করেই যেতে হয় ভেতরে। জনপ্রতি টিকিটের মূল্য ২ হাজার টাকা। কাপলের ক্ষেত্রে ১ হাজার ৫শ’। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে এই মূল্য বাড়ে-কমে।
নাচে-গানে কাঁপছে পুরো এলাকা। চারপাশের ফুলের বাগান পেরিয়ে রিসোর্টের তিন তলা ঘর। নিচতলায় চলছে পার্টি। বাতাসে তখন গানের শব্দ আর মাদকের গন্ধ। ভেতরে লেজার লাইটের ঝলকানির মধ্যে গান হচ্ছে- ‘চুপি চুপি আয় আজ, ভুলে যাব সব লাজ/ দেখ আমি সেজেছি বহুরূপী সাজে।’ স্বল্প বসনা চিয়ার্সগার্লদের ডানাকাটা পরীর মতোই লাগছিলো। যেন সব লাজ ভুলে এক আনন্দ গ্রহে বিচরণ করছেন তারা। তাদের পরনে মিনি স্কার্ট, টাইট জিন্স, পাতলা টি-শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার ও হাফ প্যান্ট।
নাচতে নাচতেই এক একজন চেয়ার্সগার্ল ফ্লাইং কিস ছুড়ে দিচ্ছিলেন দর্শক সারিতে বসা পছন্দের তরুণকে। কখনও কখনও দুই হাতে ড্যান্স ফ্লোরে যাওয়ার আহ্বান। স্বেচ্ছায় অংশ নেন অনেকে। অনেককে টেনে নিয়ে যান চেয়ার্সগার্লরা। তরুণদের কোলে বসে থাকতেও দেখা গেছে চেয়ার্সগার্লদের। রাত গভীর হয় আর দৃশ্য পরিবর্তন হয়। নাচতে নাচতে প্রকাশ্যেই গভীর চুম্বনে লিপ্ত হন তরুণ-তরুণীদের অনেকে। কেউ কেউ চকচকে নতুন টাকার নোট ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ড্যান্স ফ্লোরে। টাকা কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন বেশ কয়েক তরুণ-তরুণী। তারা আয়োজক দলের সদস্য। এই পার্টিতে অন্তত ২৫ চেয়ার্সগার্লকে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে নাচে অংশ নিতে। চেয়ার্সগার্লরা কিশোরী থেকে তরুণী। অন্যদিকে তরুণ থেকে বয়স্ক পুরুষরা অংশ নিয়েছেন ওই পার্টিতে। রিসোর্টের দ্বিতীয় তলায় যেন পার্টির মূল রহস্য। দ্বিতীয় তলার কক্ষগুলোতে জোড়ায় জোড়ায় ঢুকছেন তরুণ-তরুণীরা। ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পর দরজা খুলে বের হচ্ছেন তারা। কেউ কেউ সারা রাতের জন্য ভাড়া করে নিচ্ছেন কক্ষ। সারা রাতের জন্য ভাড়া গুনতে হয় ছয় হাজার টাকা। এসব কক্ষে টাকার বিনিময়ে যারা যান সেইসব তরুণীরা ‘ফাইটারগার্ল’ নামে পরিচিত।
সূত্রমতে, পার্টি আয়োজকদের মধ্যে রয়েছেন আনোয়ার হোসেন খোকন, বাবু আহমেদ, মানিক চৌধুরী, এহসান কবির, জুয়েল, সাগর, মনির, পলাশ, হৃদয়, রাসেল। এরমধ্যে মনির পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক, আনোয়ার হোসেন খোকন বিসিক-এর মতিঝিল অফিসের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
কথা হয় বাবুর সঙ্গে। তিনি বলেন, থানা-পুলিশ ম্যানেজ করেই পার্টির আয়োজন করা হয়। যে কারণে এখানে এনজয় করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তবে মাঝে মধ্যে আশেপাশের পোলাপান ডিস্টার্ব করে। তাদেরও ম্যানেজ করতে হয়। পুলিশ ও পোলাপান ম্যানেজ করতে টাকা ও ‘ফাইটার’ তরুণীদের কাজে লাগাতে হয় বলে জানান তিনি। প্রতি পার্টি করার জন্য পুলিশকে অন্তত ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এছাড়া রিসোর্টের ভাড়াতো আছেই।
চেয়ার্সগার্লদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নেচে-গেয়ে প্রতি রাতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করা যায়। কিন্তু ‘ফাইটার’রা প্রতি রাতে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। ‘ফাইটার’ হিসেবে অল্প বয়সী সুন্দরীদের চাহিদা বেশি বলে জানান ওই চেয়ার্সগার্ল। এই চেয়ার্স ও ফাইটারগার্লদের কেউ কেউ কয়েকটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। অর্থের প্রয়োজনেই অংশ নেন পার্টিতে। দু’তলার কক্ষেও যান। তবে অনেকেই সঙ্গীকে পছন্দ না হলে শুরুতেই না করে দেন। কখনও কখনও জোর করে নিতে চান তরুণরা। এ নিয়ে ঝামেলাও হয় অনেক সময়। বীথি, জানু, হ্যাপি, রাবু, লামিয়া, রুমা নানা পরিচিত চেয়ার্সগার্লরা। তবে এসবই ছদ্ম নাম। সেখানে কেউ তাদের প্রকৃত নাম-পরিচয় প্রকাশ করেন না।
নিচতলার দরজার পাশেই ছোট্ট একটি কক্ষ। সেখানে সারারাত নানা ধরনের খাবার তৈরি হয়। পার্টিতে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন সময়ে খাবার খেতে যান সেখানে। চেয়ার্সগার্ল রুমা জানান, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর বাবার উপর নির্ভরশীল ছিলেন তিনি ও তার এক সন্তান, ছোট ভাই-বোন এবং মা। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। মিরপুরের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রুমা। বেতন হিসেবে যা পান তাতে কোনোভাবেই চলছিলো না। এরমধ্যেই মিরপুর-১০ এলাকার প্রতিবেশী এক তরুণীর পরামর্শে প্রতি সপ্তাহে একরাত পার্টিতে যোগ দেন। শুরুর দিকে নাচতে পারতেন না তিনি। আস্তে আস্তে তা আয়ত্ত করে নেন। তবে তিনি ফাইটারগার্ল না বলে দাবি করেন। অন্যদিকে ‘ফাইটার’ এক তরুণী জানান, টাকার জন্যই এ পেশা বেছে নিয়েছেন তিনি। শখের বশে ক্লাসমেট বন্ধুদের সঙ্গে তারকা হোটেলগুলোতে যেতেন। পার্টিতে গিয়ে মাদকে আক্রান্ত হন। বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে অধিক সময় কাটানোর জন্যই ইয়াবা সেবন করতেন। এখন তা না হলে চলে না তার। পার্টিতে এসব ফ্রি পাওয়া যায়। আয়োজকরা ব্যবস্থা করেন চেয়ার্সগার্ল ও ফাইটারদের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণকারী তরুণরা চেয়ার্সগার্ল ও ফাইটারদের তা সেবন করতে দেন। ওই ফাইটার বলেন, পার্টি এখন নেশা থেকে তার পেশায় পরিণত হয়েছে। এখান যা আয় হয় তা দিয়েই বেশ ভালোভাবে দিনাতিপাত করা যায়।
রাত শেষ প্রায়। শুক্রবারের ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে। দর্শক কমছে। আস্তে আস্তে প্রায় দর্শক শূন্য। অবশ্য কেউ কেউ সঙ্গীসহ দু’তলার কক্ষগুলোতে ঘুমাচ্ছেন। সবাই যখন বের হচ্ছিলেন তখন কোনো দৃশ্য রাতের আলোর ঝলকানির ভুল ভাঙিয়ে দেয়। রাতের পার্টিতে পরীদের অনেকের সেই রূপ আর নেই। কসমেটিকসের প্রভাব চলে গেছে সকালে ফ্রেশ হওয়ার পর। এমনকি বদলে গেছে পোশাকও। কেউ কেউ বোরকা পরে বের হচ্ছেন। বুঝার উপায় নেই পুরো রাত তারা নেচে-গেয়ে মাতিয়েছেন। মাতাল হয়ে সর্বস্ব দিয়ে আনন্দ দিয়েছেন অন্যকে।