রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন গণহত্যার সামিল : তিন রাষ্ট্রদূত

ক্রাইমবার্তা রিপোট:বাংলাদেশে নিযুক্ত তিনটি দেশের রাষ্ট্রদূত কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। তারা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যে নির্যাতনের কথা আমাদের বলেছে, তা নির্যাতন নয়, বরং এটা গণহত্যা। তাই এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে এসে সমধানের পথ বের করতে হবে।’

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছান তারা। শরণার্থী শিবির পরিদর্শন যাওয়ার পথে উখিয়া সদর হাসপাতালে আন্তর্জাতিক অবিবাসন সংস্থা আইওএম পরিচালিত হাসপাতালের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।

পরিদর্শনকালে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ও কার্যক্রমের উপর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিন দেশের হাই কমিশনাররা। এরপর কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে এমএসএফ হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। সেখানে তারা মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন।

এসময় অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত এইচ ই মিস জুলিয়া নিবেট, ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত এইচ ই মিস অ্যালিসন ব্লেক ও কানাডার রাষ্ট্রদূত বিনো পিয়েরে লারামি ও আন্তর্জাতিক অবিবাসন সংস্থা আইওএম, ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

পরিদর্শন শেষে তারা কুতুপালং রেজি: ক্যাম্পের ক্যাম্প ইনচার্জএর কার্যালয়ে বৈঠক করেন। দুপুর ২টার দিকে তারা ক্যাম্প ত্যাগ করেন। হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে তিন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ সাম্প্রতিক মিয়ানমার থেকে সে দেশের সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের নির্যাতনের শিকার হয়ে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের আনরেজি ক্যাম্পে যান। সেখানে অবস্থানরত আহত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন। তারা নির্যাতনের শিকার ২০ জনের বেশি নারী পুরুষ ও শিশুর বর্বরতার কাহিনী শুনেন। প্রায় দুই ঘন্টা আলাপ আলোচনার পর প্রেস ব্রিফিং করেন একে একে তিন দেশের রাষ্ট্রদূত।

ব্রিফিংকালে তিন দেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ রোহিঙ্গাদের সাথে সদাচরণের উপর সন্তোষ প্রকাশ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ হাই কমিশনার এইচ ই মিস অ্যালিসন ব্লেক বলেন, ‘রোহিঙ্গা ও শরণার্থী সমস্যা একটি আর্ন্তজাতিক সমস্যা। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এটির আমরা সমাধান চাই। প্রয়োজনে মিয়ানমার সরকারকে সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দেয়া হবে। বাংলাদেশকেও এব্যাপারে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হবে।’ প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদেরকে উন্নত রাষ্ট্রে পুনর্বাসন করার কথা ভাবছেন বলে তিনি ব্রিফিংয়ে জানান। একই কথা বলেছেন কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার।

তিন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে কথা বলেছেন মিয়ানমারের মংডু রিয়াজ উদ্দিন পাড়া থেকে এক মাস আগে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা নাগরিক নুর আহম্মদের ছেলে পায়ে গুলিবিদ্ধ নুরুল আলম (২৬), খিয়ারী প্রাং এলাকার আলী আহম্মদের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৪৫), মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে গুলিবিদ্ধ বশির আহম্মদ (৫৫), ওয়াপ্রাং এলাকার আব্দুল জব্বারের (মৃত) ছেলে হাতে গুলিবিদ্ধ মো: আয়াজ (৩২), খিয়ারী প্রাং এলাকার আব্দুল মালেকের (মৃত) ছেলে আহত আমিন উল্লাহ (৫৬), সাত সন্তানের জননী জাহেদা আক্তার (৩০) তার জমজ পাঁচ বছরের দুই শিশুর মধ্যে একজনকে সেদেশের সেনাবাহিনীরা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। তিনি ছয় মাস বয়সী ও তিন বছর বয়সী দুই শিশুকে বুকে নিয়ে এক মাস আগে বাংলাদেশে আসেন। তার সাথেও তারা কথা বলেন।

এছাড়া রাষ্ট্রদূতরা কথা বলেছেন মিয়ানমারের সাতগইজ্জা পাড়া এলাকার গণধর্ষণের শিকার জামালিদার (২৫) সাথে। মালিদাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার স্বামীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরা গলা কেটে হত্যা করেছে। আর আমার দুই ও চার বছরের দুই শিশুকে গুলি করে হত্যার পর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছে। এরপর তারা আমাকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। অসুস্থ অবস্থায় আমি প্রায় এক মাস আগে বাংলাদেশে চলে আসি।’ দেশে চলে যাবেন কি-না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এই দেশে থাকতে চাই।’ তবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ সকল অধিকার ফিরিয়ে দিলে স্বদেশে চলে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

সিকদার পাড়া এলাকার আব্দুল মোনাফের ছেলে পেঠান আলীও অধিকার ফিরিয়ে পেলে দেশে ফিরে যাবে বলে জানান। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার ঠেঙ্গার চরে পুনর্বাসন করা হলে সেইখানে যাবেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী জানান, ঠেঙ্গার চর একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও উপকূলীয় এলাকা তাই তারা সেখানে যেতে রাজি নয়। প্রয়োজনে তারা মিয়ানমারের একটি রাজ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার ও জাতিসংঘের সহযোগীতায় থাকতে চান।

উল্লেখ্য, গত বুধবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজি আবদুর রহমান এ তিন রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপ করেন।

এদিকে গত ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন কফি আনান কমিশনের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। ৩১ জানুয়ারি মার্কিন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মার্সা বার্নিকাটসহ ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

 

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।