ক্রাইমবার্তা রিপোট:*রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা নেই * সাত মাস পরও মামলা হয়নি
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে গত বছরের জুনে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকের চালান নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই রহস্য উদ্ঘাটনের কার্যকর কোনো চেষ্টা বা তৎপরতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত এই অস্ত্রের চালানের উৎস বা গন্তব্য সম্পর্কেও কোনো তথ্য বের করতে পারেনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তিনটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) ওপর ভিত্তি করে পুলিশ তদন্ত করছে। বিস্ফোরকের ধরন নির্ণয়ের জন্য কোনো নমুনা পরীক্ষা করতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরে পাঠানো হয়নি। এমনকি ঘটনাস্থলের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি থাকা স্থাপনা বাংলাদেশ বৌদ্ধ মহাবিহারে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা থাকলেও তার ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা হয়নি।
গত বছরের ১৮, ১৯ ও ২৫ জুন তুরাগ থানাধীন মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধসংলগ্ন (বৌদ্ধমন্দিরের পেছনে) দিয়াবাড়ি খাল থেকে তিন দফায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়।
এর মধ্যে ১৮ জুন উদ্ধার করা হয় ৯৫টি ৭.৬২ বোরের পিস্তল ও ১৯২টি ম্যাগাজিন, দুটি নাইন এমএম পিস্তল ও ৮৪০টি গুলি, ১০টি গ্লোক পিস্তলের ম্যাগাজিন, এসএমজির (সাব মেশিনগান) ২৬৩টি ম্যাগাজিন ও ২১৭টি গুলি, ১০টি বেয়নেট, অস্ত্র পরিষ্কার করার ১৮০টি রড, ১০৪টি স্প্রিংযুক্ত আইএডি বক্স উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১৯ জুন এসএমজির ৩২টি ম্যাগাজিন ও ৮টি ক্লিনিং রড পাওয়া যায়।
এরপর ২৫ জুন আগের ঘটনাস্থলের প্রায় এক কিলোমিটার দূরের লেক থেকে আরও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ব্যাগগুলোতে পাওয়া যায় পাঁচটি ওয়াকিটকি, দুটি বড় আকারের বেতারযন্ত্র, দুটি এন্টোন ফিডার কেব্ল, ২২টি ছোট-বড় প্লাস্টিকের ঢাকনাযুক্ত কৌটা, যাতে ছিল বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় রড, আইসি, ক্রিস্টাল, ট্রানজিস্টার, ক্যাপাসিটার, রেজিস্টার ইত্যাদি সার্কিট, বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট ইলেকট্রনিক ডিভাইস ভর্তি ৪০টি পলিথিনের ব্যাগ, পলিথিনে মোড়ানো কালো রঙের সাত প্যাকেট বিস্ফোরক জেল, রুপালি রঙের ৫৫টি ছোট স্প্রিংযুক্ত বাক্স, সবুজ রঙের স্প্রিংযুক্ত ২৭০টি বাক্সসহ আরও কিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইস।
উদ্ধার করা অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন একেবারে নতুন, স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। এর মধ্যে ৭.৬২ বোরের পিস্তল মূলত সরকারি বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি বাহিনীর জন্য আমদানি করা পিস্তলের গায়ে উৎপাদনকারী দেশের নাম খোদাই করা থাকে। এসব পিস্তলে তা ছিল না।
অস্ত্রগুলোর ধরন ও উৎস জানতে কোনো পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রগুলো দেখে মনে হয়েছে একেবারেই নতুন। তাই কোনো ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন পড়েনি। তিনি বলেন, যে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তা ডিনামাইট প্রকৃতির। সাধারণত ভারতে খনিতে বিস্ফোরণের কাজে এমন উপাদান ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, প্যাকেটের গায়ের লেবেল দেখে বিস্ফোরকের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
সারা দেশে পুলিশের সপ্তাহব্যাপী ‘সাঁড়াশি অভিযান’ শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন এবং গুলশানের হলি আর্টিজানে রক্তাক্ত হামলার ঘটনার ১২ দিন আগে প্রথম দফার অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়।
ওই দিন (১৮ জুন) পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার বিধান ত্রিপুরা সাংবাদিকদের বলেন, সাঁড়াশি অভিযানের কারণে দুর্বৃত্তরা অস্ত্রগুলো ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এগুলো আনার পেছনে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চক্রান্ত থাকতে পারে। এরপর ২০ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অস্ত্রের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
তবে সাত মাস পর তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অস্ত্রের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কারও সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি।
এসব অস্ত্র, বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ তুরাগ থানায় তিনটি জিডি করে। তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এ ঘটনায় এখনো মামলা না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এডিসি ছানোয়ার বলেন, অস্ত্র কারও দখল থেকে পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে জিডি করা হয়। তদন্তে কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে মামলা করা হবে।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের পশ্চিম পাশে মিরপুর-আশুলিয়া বেড়িবাঁধের পাশ ঘেঁষে যাওয়া দিয়াবাড়ি খাল। ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে একটি বৌদ্ধমন্দির। বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। সেখান থেকে ঘটনাস্থলটি স্পষ্ট দেখা যায়।
খালের যেখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি তিন রাস্তার মোহনা। সোজা পূর্ব দিকে ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সেতু। ওই রাস্তা দিয়ে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের খালপাড় হয়ে বের হওয়া যায়। দক্ষিণের রাস্তাটি বৌদ্ধমন্দিরের সামনে দিয়ে বেড়িবাঁধে উঠেছে। আর উত্তরে রাস্তাটি বেড়িবাঁধে উঠেছে একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের কারখানার সামনে দিয়ে।
তুরাগ থানার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই তিনটি রাস্তা ছাড়াও ঘটনাস্থলে গাড়ি নিয়ে যেতে আরও পাঁচটি রাস্তা আছে। পার্শ্ববর্তী বাউনিয়ার উলুদাহ গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা আর উত্তরার ১২ নম্বর খালপাড়ের আশপাশে রয়েছে বাকি চারটি রাস্তা।
ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত বের হওয়া সহজ দুটি রাস্তা হলো বৌদ্ধবিহারের সামনের রাস্তা ও একটি নির্মাণপ্রতিষ্ঠানের কারখানার সামনের রাস্তা।
ওই বৌদ্ধবিহারের আবাসিক ভিক্ষু মুদিতা পাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ছয়টি সিসি ক্যামেরা আছে। দুটি ক্যামেরা রাস্তার দিকে মুখ করানো। দিয়াবাড়ি খাল থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর পুলিশের কর্মকর্তারা বিহারে গিয়ে নাশতা করেছিলেন, কিন্তু সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজ তারা সেখান থেকে নেননি। ভিক্ষু মুদিতা পাল বলেন, তাঁদের ক্যামেরার ফুটেজ এক মাসের বেশি থাকে না। তাই এখন আর ওই দিনের ফুটেজ সংগ্রহের সুযোগ নেই।
অস্ত্রের চালানটি উদ্ধারের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল দক্ষিণখান থানার কনস্টেবল শহিদুল ইসলামের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৮ জুন বিকেলে তিনি স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে বেড়াতে যান। বৌদ্ধমন্দির দেখে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফেরার পথে দেখেন খালের পাড়ে কালো রঙের একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে, সেটার পাশে তিনটি ছেলে তিন দিকে তাকিয়ে আছে। খালের পাড়ে আরও দুজন। একজন কোমর বাঁকা করে নিচু হয়ে ছিল। তার হাতে ধরা ছিল একটি ব্যাগ। সেটি নামাচ্ছিল না তুলছিল, তা তিনি নিশ্চিত নন।
শহিদুল বলেন, কেউ খালে লাশ ফেলছে, এমনটা ভেবে তিনি দ্রুতবেগে সেখান থেকে চলে যান। ১০-১৫ মিনিট পর আমতলায় মোটরসাইকেল থামান এবং তুরাগ থানার ওসিকে ফোন করে ঘটনাটি জানান। ওসি তাঁকে সেখানে থাকতে বলেন এবং থানা থেকে পুলিশ পাঠান। পুলিশ আসার পর তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আর ওই গাড়িটি দেখেননি। খালের কিনারে পানিতে অস্ত্রভর্তি ব্যাগগুলো পান।
ছয় দিন পর প্রায় এক কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকের লেক থেকে আরও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই লেকে মাছের খামারের তত্ত্বাবধায়ক ইয়াছিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২৪ জুন দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি লেকের এক প্রান্তে নৌকার ওপর বসে ছিলেন। হঠাৎ দেখেন মিরপুর বেড়িবাঁধের দিক থেকে লেকের লাগোয়া পাকা রাস্তা ধরে একটি গাড়ি আসছে। সেটি পেছনে দিকে চলছিল। লেকের পাড়ে এসে গাড়িটি থামে এবং সব লাইট বন্ধ করে দেয়।
ইয়াছিন আলী বলেন, তিনি ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর গাড়ির দিকে টর্চলাইট জ্বালান। দেখেন লেকের পার থেকে দুজন দৌড় দিয়ে ওঠেন এবং খুব দ্রুত গাড়ি আবার বেড়িবাঁধের দিকে চলে যায়। গাড়িটি ছিল পাজেরো আকৃতির।
সবগুলো অস্ত্র, বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম একই ব্যক্তিরা রেখে গেছেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছানোয়ার বলেন, ‘অনুমান থেকে বলছি, একই ব্যক্তিরা এসব করেছে। সবগুলো মেটেরিয়ালস দেখে মনে হয় ঘটনাটি পরিকল্পিত। কারও স্টোরেজে ছিল, প্রয়োজন মনে করেনি বলে ফেলে রেখে গেছে।’ তিনি বলেন, উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সংস্থা রয়েছে, তাদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করেছেন। কিন্তু তদন্তের কাজে লাগতে পারে এমন কোনো তথ্য এখনো পাননি।
এ ছাড়া এই চালানে এসএমজির গুলি-ম্যাগাজিন পাওয়া গেলেও এসএমজি পাওয়া যায়নি। তাই এই অস্ত্র চালানের আরেকটি অংশ পাচার বা কোথাও থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা। তাঁদের মতে, যে ধরনের ওয়াকিটকি ও বড় বেতারযন্ত্র, অস্ত্র পরিষ্কারের রড ও অন্যান্য সরঞ্জাম পাওয়া গেছে, তা সাধারণ সন্ত্রাসী চক্রের কাছে থাকার কথা নয়। এ রকম অস্ত্র, বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জাম ইতিপূর্বে দেশের কোথাও উদ্ধার হয়েছিল কি না বা সচরাচর কারা এ ধরনের সরাঞ্জাম ব্যবহার করেন, এর মধ্যে কোনটা কালোবাজারে পাওয়া যায় আর কোনটা পাওয়া যায় না—তদন্তে এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হয়েছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাটি তখনই তাঁর কাছে রহস্যজনক মনে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী হয়তো অস্ত্রগুলো আগে উদ্ধার করেছিল। এখানে তারা বা তাদের কোনো সোর্স ফেলে রেখে গিয়েছিল পরবর্তী সময়ে আবার উদ্ধার দেখানোর জন্য। এ ছাড়া যদি অস্ত্র চোরাচালানকারী কেউ ফেলে রেখে যায়, সে ক্ষেত্রে চোরাচালানের সঙ্গে সব সময়ই প্রভাবশালী কেউ না কেউ জড়িত থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তারা হয়তো বিষয়টি জানেন, তাই তাঁরা তদন্ত করছেন না।’