ক্রাইমবার্তা স্পোর্টস ডেস্ক:পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে ঢুকতেই দেখা গেল বাহারি চুলের কয়েকজন কেনিয়ান ছেলেমেয়ে। কারও সবুজ, কারও লাল। তাঁরা মূল স্টেডিয়াম চত্বরে এসে কুশল বিনিময় করছিলেন আরেকটি দলের সঙ্গে। এঁরা ব্রিটিশ। পাশ দিয়ে উগান্ডার পাঁচ খেলোয়াড় চলে গেলেন। এভাবে মিনিট কয়েক সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা মিলল আরও অনেক বিদেশির।
বলতে পারেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চত্বরে এখন বিদেশির মেলা। নানা বর্ণ, ধর্ম…সব মিলেমিশে যেন একাকার। আফ্রিকার বেনিন, উগান্ডা, ঘানাসহ অন্য দেশগুলোর সংস্কৃতির ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে এখানে। এঁদের নিজস্ব পোশাক, চুলের কাটিং, সবই অন্য রকম। এই দলগুলোর সঙ্গে যদি সুখী দেশ ডেনমার্কের খেলোয়াড়দের দেখা হয়ে যায়, দৃশ্যটা হয়ে ওঠে আরও ব্যতিক্রম। গতকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেটি দেখা গেল। ওই অনুষ্ঠানে তো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছিলেন উরুগুয়ে, তুরস্ক, ভুটান, বেনিনসহ অন্য দেশগুলোর খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা!
সাধারণত বড় বড় গেমসেই এমন ছবি দেখা যায়। এবার চতুর্থ রোল বল বিশ্বকাপের সৌজন্যে ঢাকাও যেন এক টুকরো আফ্রিকা, এশিয়া বা ইউরোপ। গতকাল ৪০ দেশের এই টুর্নামেন্টের উদ্বোধন হলো পল্টন মাঠেই নব নির্মিত শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বা গোটা আয়োজন নিয়ে বিস্তর সমালোচনা ও হাসাহাসি আছে। তবে প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, বাংলাদেশের খেলাধুলার সংসারে এত বড় বিশ্বকাপ কখনো হয়নি। ক্রিকেটে বিশ্বকাপ হয়েছে, কিন্তু সেখানে তো দল থাকে অল্প কয়েকটি।
সেই দিক থেকে রোল বল বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটা নতুন সংযোজন। কিন্তু খেলাটা সম্পর্কে মানুষরে ধারণা না থাকায় এটি সেভাবে মনোযোগ কাড়তে পারছে না। তবে খেলাটার মধ্যে মজা আছে অনেক।
এটি আসলে কয়েকটি খেলার মিশেল। সহজে বললে হ্যান্ডবলের আধুনিক সংস্করণ। হ্যান্ডবল যেমন হাতে খেলা হয়, এটিও তা–ই। পার্থক্য হলো এখানে খেলোয়াড়দের পায়ে থাকে স্কেটিং এবং বলটা বাস্কেটবল। এ ছাড়া হ্যান্ডবলের মতোই হাতে খেলা এবং এখানেও পোস্টে বল ঢোকালে গোল।
কোর্টে থাকেন ছয়জন খেলোয়াড়। ডাগআউটে আরও ছয়জন। হকির মতো যেকোনো সময় খেলোয়াড় বদল করা যায়। এখানে অবশ্য হ্যাটট্রিক নেই। খেলাটা হয় দুই অর্ধে ১৫ মিনিটে করে, মাঝখানে ৫ মিনিট বিরতি। গোল হয় ভূরি ভূরি। বাংলাদেশ যেমন গতকাল প্রথম ম্যাচেই হংকংয়ের কাছে আগে গোল খেয়ে পরে ১৯টি দিয়েছে। এত এত গোল দেখা রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপারই।
কিন্তু বিশাল এ আয়োজনটি যেভাবে করা যেত, নানা সংকটে সেভাবে হচ্ছে না। আবাসন একটা বড় সমস্যা। বিভিন্ন ক্রীড়া স্থাপনাগুলোতে রাখা হয়েছে কিছু দলকে। কিছু আছে হোটেলে। কিছু এদিক-সেদিক। এভাবে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকায় নানা সমস্যা হচ্ছে। এসব নিয়ে আছে অনেক অভিযোগ। কেনিয়া দলের ভাষ্য অনুযায়ী থাকার জায়গা প্রথমে পায়নি তারা। হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে বসে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের।
সবচেয়ে বেশি চোখে লেগেছে, এই বিশ্বকাপের জন্য পল্টন ময়দানে প্রায় ১২ কোটি টাকায় যে শেখ রাসেল কমপ্লেক্স করা হয়েছে, উদ্বোধনের আগেই সেটির মেঝেতে দেখা গেছে বড় এক গর্ত! যে গর্তে পা ঢুকে গেছে খোদ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিবের!
টুর্নামেন্টে সাংবাদিকদের জন্য যে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড করা হয়েছে, সেটিও ভুলে ভরা। বাংলাদেশের ইংরেজি বানানে ‘ডি’ শব্দটিই নেই। সেই ভুল সংশোধন করে নতুন ফিতা ছাপানো হলো, সেখানেও ভুল! এবার খোদ রোলার স্কোটিং ফেডারেশনের বানানই ঠিক নেই! সংবাদমাধ্যমের নাম না লিখে গণহারে সবার প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয়েছে ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ’! একটা বিশ্বকাপ হচ্ছে, অথচ কোনো প্রেস সেন্টার নেই।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক কিছুই না থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আরও গুছিয়ে টুর্নামেন্টটি আয়োজন করা কঠিন কিছু ছিল না। হয়তো অভিজ্ঞতার অভাবেই এমনটা হয়েছে। তবে ঘরের মাঠে একটা বিশ্বকাপ, আর সেটির উত্তেজনা থাকবে না, তা কি হয়! হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ কাল খেলার সময় ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ চিৎকার শোনা গেছে অনেক। যা দেখে বিদেশিরাও একটু চমকে গেছেন।
এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার অনেক দেশেরই প্রতিনিধিত্ব আছে এখানে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ানদের উপস্থিতি বেশ সাড়ম্বর। কানাডা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ডেনমার্কসহ অন্যরা এ দেশে এসে একটা বার্তাই ছড়িয়ে দিল, বাংলাদেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। এই টুর্নামেন্ট থেকে এটিই আসলে সবচেয়ে বড় অর্জন হতে পারে। ২৩ ফেব্রুয়ারি টুর্নামেন্টটি শেষ হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ঠিকঠাক রাখা গেলে বাংলাদেশ বড় মুখ করে বলতে পারবে, ‘আমরাও পারি’।
টুর্নামেন্টের প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ডেনমার্ক। পরের দুবার ভারত। এবার ভারতের হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতার সুযোগ। তবে কে চ্যাম্পিয়ন হলো সেটি নিয়ে বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশ চায় বিশ্বকাপটা সফলভাবে শেষ করতে। দেশের জন্য এটি যে বড় চ্যালেঞ্জ!