স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবেন খাদিজা

ক্রাইমবার্তা রিপোট:সিলেটে বদরুলের চাপাতির আঘাতে গুরুতর আহত কলেজ ছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। দুই/এক দিনের মধ্যে তাকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

আজ বৃহস্পতিবার বেলা এগারটার সময় সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি) তে সংবাদ সম্মেলনে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ও পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পর্ণবাসন কেন্দ্র (সিআরপি )’র হেড অব মেডিকেল সার্ভিস এবং নিউরোলোজীর কনসালটেন ডাঃ সাঈদ উদ্দিন হেলাল সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

ডাঃ সাইদ বলেন, খাদিজা গত বছরের ২৮ নভেম্বর সিআরপিতে ভর্তি হয়। তখন আট সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তার চিকিৎসা শুরু হয়। বিভিন্ন থেরাপি ও কাউন্সেলিং এর সাথে সাথে বিভিন্ন সময় তার সিটি স্ক্যান ও বিভিন্ন ধরনের পরিক্ষার জন্য তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পাঠানো হয়। দীর্ঘ তিন মাসের চিকিৎসার পর তিনি এখন তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।

মেডিকেল সার্ভিসেস উইং রেজিট্রার ডাঃ ইসরাত জাহান ঊর্মি বলেন, প্রাথমিকভাবে সিআরপি তে আসার পর আমরা খাদিজার কিছু পরীক্ষা করি। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রক্তক্ষরণের কারনে এবং টেন্ডন ইঞ্জুরির কারনে তার বাম পাশ নিস্ক্রিয় ছিল। বর্তমানে তার আর কোন সার্জারি প্রয়োজন নাই, তিনি এখন সুস্থ আছেন এবং তিনি সক্রিয়ভাবে নিজের সব কাজ করতে পারছেন। তার কোন খিচুনি নাই এবং তার যৎসামান্য কিছু ঔষধ চলছে।

সিআরপি’র নিউরলজি বিভাগের ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট সুলক্ষনা শ্যামা বিশ্বাস বলেন, শুরুতে খাদিজার মুলত হেড ইঞ্জুরি ও বাম হাতের টেন্ডন ইঞ্জুরি ছিল। এছাড়াও তার আরও যে সমস্যাগুলো ছিল সেগুলো হল- বাম কাঁধের ব্যাথা, বাম পাশের -কাধ, আক্সগুল, হিপ ও গোড়ালির সীমিত নড়াচড়া এবং তার আঘাতপ্রাপ্ত পাশের টোন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল।

তার ভারসাম্যের স্কোর ছিল ৫৬ এর মধ্যে ১৩, যার ফলে সে তার চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়াও তার ট্রানজিশনাল মুভমেন্ট (বিছানায় এক কাত থেকে অপর কাত হওয়া, শোয়া থেকে বসা, বসা থেকে দাঁড়ানো), হাঁটা এসব কিছুর জন্য সে পরিবারের উপর নির্ভরশীল ছিল। তিন মাসের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান স¤পন্ন করার পর বর্তমানে তার কাধে কোন ব্যাথা নেই, বাম পাশের প্রত্যেক জয়েন্টের মুভমেন্ট বেড়েছে। তার ভারসাম্যের স্কোর ১৩ থেকে বেড়ে ৪৫ এ দাঁড়িয়েছে যার অর্থ সে স¤পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলাচলে সক্ষম। আমাদের ফিজিওথেরাপি বিভাগের পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি আমাদের ফলোআপে থাকবেন। বর্তমান অবস্থার আলোকে আমরা আশা করছি খাদিজা তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবেন।
স্পিচ এন্ড ল্যাক্সগুয়েজ থেরাপি বিভাগের ক্লিনিক্যাল স্পিচ এন্ড ল্যাক্সগুয়েজ থেরাপিস্ট তাহমিনা সুলতানা বলেন, খাদিজাকে শুরুতে যখন পরীক্ষা করা হয় তখন তার মুখের মাংসপেশিতে, জিহ্বা নড়াচড়াতে দুর্বলতা ছিল যে কারনে তার কথায় জড়তা ছিল এবং কণ্ঠস্বর নিচু থাকার কারনে কথা ধীরে শোনা যেত। এছাড়াও খাদিজার অন্যের কথা বুঝতে সমস্যা হত, স্মৃতিশক্তি কমে গিয়েছিল, মনোযোগে সমস্যা ছিল। বুদ্ধিমত্তার কার্যক্রমগুলো যেমন- কোন সমস্যার সমাধান করা, ক্যালকুলেশন করা, ভাল-মন্দ পার্থক্য করা, কোন কাজের ধাপসমূহ বর্ণনা করা, কোন ঘটনা গুছিয়ে বলা – তে সমস্যা ছিল।

নিয়মিত থেরাপি নেয়ার পর বর্তমানে খাদিজা ¯পষ্টভাবে কথা বলতে পারে, অন্যের কথা ভালভাবে বুঝতে পারে, তার স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি এখন গুছিয়ে কথা বলা, যেকোনো সমস্যার বিভিন্ন ধরনের সমাধান বলা, ক্যালকুলেশন করা, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ভাল-মন্দ পার্থক্য করা- এ কাজগুলো খুব ভালভাবে করতে পারেন। তার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে আমরা আশা করছি তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। অকুপেশনাল থেরাপি বিভাগের ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট মানসুরা আক্তার বলেন, খাদিজা আমাদের কাছে যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে আসছিলেন তা হচ্ছে – শরীরের বাম পাশটা দূর্বল থাকার কারনে সে তা ব্যবহার করতে পারত না। তার দৈনন্দিন জীবনের কাজ যেমন: খাওয়া-দাওয়া করা, ব্রাশ করা , চুল আচড়ানো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলাফেরা করা , লেখাপড়া করা , সামাজিকতা ইত্যাদি সে নিজে নিজে কিছুই করতে পারত না। এছাড়াও এই সমস্ত কাজের জন্য সে অন্যের উপর ১০০ ভাগ নির্ভর ছিল। এই সমস্যার আলোকে আমরা তার জন্য স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা পরিকল্পনা করি এবং সে অনুযায়ী তাকে বিভিন্ন রকম সিমুলেটেড কাজে অংশগ্রহন করার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করানো হয়।অকুপেশনাল থেরাপির বিভিন্ন চিকিৎসা গ্রহনের মাধ্যমে প্রায় তিন মাসের মধ্যে খাদিজা এখন তার দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কাজেই প্রায় ১০০ ভাগ স¦নির্ভর। আমরা মনে করছি খাদিজা এখন তার প্রধান লক্ষ্য কলেজে যাওয়া ও পড়াশোনা করার জন্য অর্থ্যাৎ তার স¦াভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
সিআরপি’র কাউন্সেলর মোঃ আব্দুল জব্বার ও আরেক কাউন্সিলর খাদিজা আক্তার বলেন, সিআরপিতে ভর্তি হবার পর চিকিৎসা পরিকল্পনার অংশ হিসাবে খাদিজার মানসিক সমস্যা নিরুপন ও চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ভর্তির সময় মানসিক সমস্যা নিরুপনে ঘটনার প্রভাব সম্পর্কিত আদর্শ স্কেল ব্যবহার করা হয়। যদিও ঘটনার কোন প্রভাব তার সামগ্রিক মানসিক অবস্থায় ছিল না কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নে প্রতিক্রিয়া ছিল নানাবিধ সমস্যা প্রবন। তার মধ্যে ডিনিয়েল টেনডেনসি ছিল- ঘটনা মনে করতে চাই না, ফেয়ার ঘটনার বিবরণ শোনা বা ভিডিও দেখা, অতিরিক্ত রক্ষা প্রবনতা-একাকী চলাচলে জড়তা ছিল। এই সমস্যাগুলো শুধুমাত্র তার মধ্যেই ছিল না তার পরিবারের সদস্যদেরও মধ্যে ছিল। তাকে মানসিক চিকিৎসা- কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপী দেয়া হয় এবং পরিবারের লোকজনকেও পরামর্র্র্শ দান করা হয়। বর্তমানে তার মানসিক অবস্থা খুবই ভাল। তিনি বাস্তবকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় প্রত্যয়ী। ঘটনা প্রবাহে সকল ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ নির্বিঘেœ স্মরণ করা, ভিডিও দেখা, ঘটনাকে অন্যের নিকট বর্নণা করা এবং সর্বোপরি ঘটণার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ জীবনে সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছাপোষণ ইঙ্গিত করে যে তিনি মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিআরপি’র নির্বাহী পরিচালক মোঃ সফিকুল ইসলাম, মেডিকেল সার্ভিসেস উইং এর প্রধান ডাঃ সাইদ উদ্দিন হেলাল, প্রশাসন প্রধান মোঃ শহিদুর রহমান, খাদিজার বড় ভাই শাহীন আহম্মেদ ও তার এক চাচী,খাদিজার সকল থেরাপিস্ট, কাউন্সেলররা।
খাদিজা বলেন- আমি এখন হুইল চেয়ার ছাড়া নিজে নিজে চলা ফেরা করতে পারি। আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ্য। বাড়ীতে গিয়ে পড়া-শুনা করতে চাই । আমি ভবিষ্যতে ব্যাংকার হতে চাই।
উল্লেখ্য গত বছরের ৩ অক্টোবর শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক বদরুল সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শ্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজাকে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন । প্রথমে খাদিজাকে গুরতর অবস্থায় সিলেটের ওসমানী হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয় যেখানে প্রায় ২ মাস যাবত বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর তাকে পুনর্বাসনের জন্য গত বছরের ২৮ নভেম্বর-২০১৬ সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্েরর অ্যাম্বল্যান্সে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল থেকে সরাসরি সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পর্ণবাসন কেন্দ্র (সিআরপি)’তে ফিজিওথেরাপির জন্য স্থানান্তর করা হয় । সিআরপি’র মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম খাদিজাকে পর্যবেক্ষণের পর ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনালথেরাপিস্ট এবং কাউন্সেলরদের নিয়ে আট সদস্যের একটি বিশেষ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। এই বিশেষ টিম খাদিজার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তিন মাসের চিকিৎসা পরিকল্পনা করে।

 

Check Also

৩০ জুলাই পর্যন্ত অনেক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, সংগ্রামে যুক্ত হবে কি না: সারজিস আলম

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।