ক্রাইমবার্তা রিপোট:দুই মেয়েকে নির্যাতন করে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। সেই দুই মেয়ে এখন কিশোরগঞ্জ কারাগারে। দুই মেয়ের জন্য মায়ের এমন আহাজারি।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব পৌর শহরের রিকশাচালক বাবার দুই মেয়ে। একজন এবার দশম শ্রেণিতে পড়ে। আরেকজন দুই শিশু সন্তান ও স্বামী নিয়ে ঘর-সংসার করেন।
ওই দুই বোন এখন কিশোরগঞ্জ কারাগারে। ২০১৫ সালের একটি ঘটনায় করা নাশকতার মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়েছেন ভৈরব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নজমুল হুদা।
দুই বোনের পরিবারের অভিযোগ, এসআই নজমুল হুদার আচরণের প্রতিবাদ করায় তিনিসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা দুই বোনকে কিল-থাপ্পড় ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থানায় নিয়ে যান। সেখানে নিয়েও দুই বোনকে নির্যাতন করা হয়।
দুই বোনের মুক্তির দাবিসহ এসআই নজমুল হুদার বিচার দাবি করেছেন তাঁদের পরিবার ও এলাকাবাসী।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া দুই বোন ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর মুসলিমের মোড় এলাকার রিকশাচালক মো. খায়ের মিয়ার মেয়ে। তাঁর দুই মেয়ের একজন বুশরা আক্তার পান্না। সে স্থানীয় কমলপুর হাজি জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের মানবিক শাখার দশম শ্রেণির ছাত্রী। আরেক মেয়ের নাম বন্যা আক্তার (২০)। নূরুল ইসলাম নূর (৭) ও গোলাম মোস্তফা (৫) নামে তাঁর দুই সন্তান রয়েছে।
খায়ের মিয়া ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম বীনা জানান, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার দুপুরে একটি ডাকাতি মামলার সন্দিগ্ধ আসামি তাঁদের ছেলে কাউছারকে (২৫) গ্রেপ্তার করতে এসআই নজমুল হুদার নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাঁদের বাড়িতে আসে। পুলিশ সদস্যরা আচমকা তাঁদের বাড়ির টিনের তৈরি প্রধান দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে পড়েন। তখন ঘরে থাকা দুই বোন বুশরা ও বন্যা এগিয়ে গিয়ে বাড়ির গেটের কড়া না নেড়ে ভেঙে ঢোকার প্রতিবাদ করেন। এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে নাজমুল হুদা দুই বোনকে কিল-থাপ্পড় ও লাঠি দিয়ে পেটান এবং ঘরে ঢুকে কাউছারের খোঁজ করেন। এ সময় পুলিশ সদস্যরা তাঁদের ঘরের আসবাব ও মালামাল তছনছ করতে থাকলে দুই বোন আবার প্রতিবাদ করেন। একপর্যায়ে কাউছারকে না পেয়ে দুই বোনকে আবারও মারধর করে ধরে থানায় নিয়ে যান এসআই নাজমুল। সেখানে নিয়েও দুই বোনকে বেধড়ক পেটান নজমুল ও অন্য পুলিশ সদস্যরা।
ভৈরব থানার পুলিশ জানায়, ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টার দিকে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় ভৈরব থানার অদূরে আলশেফা হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাসে থাকা এক যাত্রী পিকেটারদের ইট-পাটকেলে আহত হন। ওই বছর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ওই ঘটনায় পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ভৈরব থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলায় সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে দুই বোনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবারই আদালতে সোপর্দ করেন এসআই নজমুল।
মরিয়ম বেগম বীনা জানান, গত সোমবার তাঁরা কিশোরগঞ্জ কারাগারে দুই মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন মেয়েরা তাঁদের সঙ্গে এসআই নজমুল হুদাসহ অন্যদের অশালীন আচরণসহ শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
মরিয়ম বলেন, ‘মেয়েরা এমন অশালীন আচরণের কথা বলেছেন, যা আমি আপনাদের সামনে বলতে পারব না।’ বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এদিকে খায়ের মিয়ার বাড়িতে পুলিশি অভিযান ও দুই বোনকে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশীরাও। প্রতিবেশী গৃহবধূ রীনা বেগম বলেন, ‘পুলিশ বাড়িতে ঢুকেই মেয়ে দুটিকে মারধর শুরু করলে আমি তাদের কান্না, চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসি এবং তাদের না মারতে অনুরোধ করি। তখন নজমুল দারোগা আমাকেও গালিগালাজ শুরু করলে আমি চুপ করে থাকি।’
একই রকম বর্ণনা দেন প্রতিবেশী যুবক শিপন মিয়া ও গৃহবধূ সামসুন্নাহার বেগম। তাঁরা জানান, শনিবার একপর্যায়ে এসআই নজমুল হুদা মোবাইল ফোনে কল করে থানা থেকে নারী পুলিশ সদস্য এনে বুশরা-পান্নাকে উঠিয়ে নিয়ে যান।
বুশরা ও পান্নার রিকশাচালক বাবা খায়ের মিয়া জানান, তিনিসহ তাঁর পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। তিনি ২০১৩ সাল থেকে পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে তিনি কাজও করেছেন।
খায়ের মিয়া বলেন, ‘আমি একজন আওয়ামী লীগার হওয়া সত্ত্বেও আমার মেয়েরা কী করে বিএনপি-জামায়াতের পিকেটিংয়ে অংশ নিয়ে গাড়িতে ইট-পাটকেল ছুড়ে মানুষ হত্যা করে? মামলার বর্ণনা মতে, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই ঘটনা ঘটে। সেবার আমার ছোট মেয়ে জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। আর বন্যা তো ছিল তাঁর স্বামীর বাড়ি গজারিয়া ইউনিয়নের মানিকদী গ্রামে।’
খায়ের মিয়া বলেন, মিথ্যা ও বানোয়াট ঘটনায় তাঁর মেয়েদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়েছে এবং জেলে পাঠানো হয়েছে। তিনি ওই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এসআই নজমুল হুদার বিচার দাবি করেন।
এদিকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী বুশরা আক্তার পান্নাকে নম্র-ভদ্র ও শান্ত হিসেবে উল্লেখ করে তার বিদ্যালয় কমলপুর হাজি জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লেফটেন্যান্ট মো. অহিদুর রহমান জানান, তিনি এ ঘটনায় খুবই মর্মাহত হয়েছেন। ঘটনাটিকে অত্যন্ত দুঃখজনক আখ্যা দিয়ে তিনি বুশরার মুক্তি দাবি করেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভৈরবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে কোনো নারী পিকেটার অংশ নিয়েছেন বলে জানা নেই। সেটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি বা যেকোনো রাজনৈতিক দলই হোক না কেন। তিনি ঘটনাটির যথাযথ তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেন।
ঘটনাটি মুঠোফোনে জানালে ভৈরব পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মো. জাকির হোসেন কাজল জানান, তিনি বর্তমানে কক্সবাজার সফরে আছেন। সেখান থেকে এসে তিনি বিষয়টি দেখবেন।
এদিকে দুই বোনকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই নজমুল হুদা জানান, দুই বোন নাশকতা মামলার পলাতক আসামি। ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ।
দুই বোনকে তো মামলার সন্দিগ্ধ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলার এজাহারেও তাঁদের নাম নেই। তাহলে তাঁরা কীভাবে পলাতক আসামি হলেন এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এসআই নজমুল কোনো বক্তব্য দেননি।
ভৈরব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমদের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি আদালতের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসহ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁর কাছে এসেছিলেন বলে তিনি জানান।