অবস্থান এবং সীমানা: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা হলো সাতক্ষীরা। এই জেলার উত্তরে যশোর জেলা, পূর্বে খুলনা জেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং পশ্চিমে ভারতের ২৪ গরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমা অবস্থিত। আয়তন: সাতক্ষীরা জেলা উত্তর দক্ষিণে দীর্ঘ। জেলার আয়তন ১,৪৫৩ বর্গমাইল। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত। যার আয়তন ৫৭৪ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা: ২০০১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী জেলার মোট লোকসংখ্যা ১৮,৪৩,১৪৩। এর মধ্যে পুরুষ ৯,৩৮,৭৫৬ এবং ৯,০৪,৩৮৭ জন। সাতটি উপজেলা ৮টি থানা, ২টি পৌরসভা এবং ৭৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা জেলা। নামকরণ: সাতক্ষীরা জেলার নামকরণ সম্পর্কে কয়েকটি মত প্রচলিত আছে। এর মধ্যে প্রধান মতটি হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক কর্মচারী বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী নিলামে বুড়ন পরগনা কিনে তার অন্তর্গত সাতঘরিয়া গ্রামে বাড়ি তৈরি করেন। তার পুত্র সাতঘরিয়া এলাকায় উন্নয়মূলক কাজ করে ব্যাপক পরিচিত লাখ করেন। ১৮৬১ সালে মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ইংরেজরা তাদের পরিচিত সাতঘরিয়াকে তাদের কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতোমধ্যে ইংরেজি কর্মচারীদের মুখে সাতঘরিয়া সাতক্ষীরা হয়ে গিয়েছিল। এই পুরাতন সাতঘরিয়া এখন সাতক্ষীরা। জলবায়ু: সাতক্ষীরা জেলা ক্রান্তীয় মওসুমী জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে আর শীতকালে উত্তর দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। মওসুমী বায়ুর প্রভাবে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। জেলার দক্ষিণে বিশ্বের ম্যানগ্রোব জাতীয় সুন্দরবনের অবস্থান থাকায় উত্তরাঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। সমুদ্র উপকূলে সুন্দরবনের অবস্থান বলে এ জেলা বিশাল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছবাস থেকে এ জেলা। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সিডর, আইলা, নার্গিসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ জেলা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বর্তমানে এ জেলাটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে চরম হুমকির মুখে। ভূমি: সাতক্ষীরা মূলত: ভূমি মূলত: পলি বিধৌত সমভূমি। এই ভূমি বালি মিশ্রিত। ভূমি গঠনের দিক থেকে জেলার মৃত্তিকা দুইভাগে ভাগ করা যায়। উত্তরাঞ্চলের মাটি দো-আশ পলিবহুল। সেখানে ধান, পাট, আখ, শাকসবজি ইত্যাদির চাষ করা হয় দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মাটি এঁটেল। জোয়ার ভাটার পানি দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে প্রবাহিত বলে এখানকার মাটি লবণাক্ত। তাই এখানে মাছ চাষ ভাল হয়। বিশেষ করে বাগদা চাষের জন্য সাতক্ষীরা জেলা দক্ষিণাঞ্চালের মধ্যে বিখ্যাত। দেশের প্রায় ৫০ ভাগ চিংড়ী সাতক্ষীরায় উৎপাদন হয়। নদনদী: সাতক্ষীরা জেলার পূর্ব পশ্চিম সীমা এবং মধ্যবর্তী অঞ্চলে গঙ্গা ও পদ্মার কয়েকটি শাখা নদী বহুমুখী হয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সাতক্ষীরার উত্তরাঞ্চলের এসব নদী পলি পড়ে ভরাট হয়েছে। শুধুমাত্রা সমুদ্র তীরবর্তী এবং জেলার দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হওয়ায় কয়েকটি প্রধান নদীর নাব্যতা পুরোপুরি হারায়নি। এর মধ্যে যমুনা, ইছামতি, কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া সোনাই, বেতনা, রায়মঙ্গল, মরিচচাপ উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় সামাজিক অবস্থা: আদিকাল থেকে সাতক্ষীরার মানুষ অনেকটা সহজ, সরল ও সাধারণ প্রকৃতির। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস। দ্বিতীয় অবস্থানে হিন্দু, অল্পকিছু সংখ্যক খৃস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করে। ধর্মীয় মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন যাবত প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। এ জেলায় কখনও কোনদিন সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটেনি। বরং একে অপরের মিলেমিশে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করেছে। রাজনৈতিক অবস্থান: ভৌগোলিক ও সামাজিক কারণে এ জেলার মানুষ আগে ধর্মপ্রাণ। স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগের পর পরই মুসলিম লীগের অবস্থান। বর্তমানে এ জেলায় ইসলাম পন্থীদল হিসেবে জামায়াতের অবস্থান মজবুত। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, তৃতীয় পর্যায়ে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অবস্থান। ২০০১ সালের নির্বাচনে জেলার ৫টি আসনেই ৪ দলীয় জোটের প্রার্থীরা সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর মধ্যে জামায়াতের ৩টি, বিএনপির একটি এবং জাতীয় পার্টি (নাফি) একটিতে জয়লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২টি এবং জাতীয় পার্টি ২টিতে জয়লাভ করে। উন্নয়ন: চিংড়ী মাছ, সুন্দর বন, ভোমরা স্থল বন্দর বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর এ জেলায় তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। বর্তমান সরকার এ জেলায় ব্রিজ, কালভার্ট, শিক্ষা ভবন, বিদ্যুৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন করলেও আনুপাতিক হারে এ জেলা পিছিয়ে রয়েছে বিশেষ করে সাতক্ষীরা শহরের পাশে বাইপাস সড়ক নির্মাণ আশাশুনি সড়ক সংস্কার এবং সাতক্ষীরা সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণসহ বেশকিছু দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু এসব দাবি বার বার উত্থাপিত হওয়ার পরও উপেক্ষিত। ইতিহাস ঐতিহ্য: প্রাচীন ও মধ্যকাল এবং মোগল আমলে অসংখ্য রাজা, বাদশা, সুফী-দরবেশ, পীর ও আওলিয়া সাধু সন্ন্যাসীর স্মৃতিবিজড়িত সাতক্ষীরার ইতিহাস গৌরব উজ্জ্বল। তাচাড়া সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য ও গাছ-গাছালির অপরূপ সৌন্দর্য যেকোন মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে। পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্র হরিণের অধিকাংশ সাতক্ষীরা জেলা সংলগ্ন সুন্দরবন এলাকায় বসবাস করে। এছাড়া নদীতে কুমির, গাছে বানর ও পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ সুন্দরবনকে করেছে অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত। এছাড়া শ্যামনগরের বংশীপুর, শাহী মসজিদ, ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী মন্দির, হাম্মামখানা, জমিদার বাড়ী, মৌতলাব জাহাজঘাটা নৌদুর্গ, দেবহাটার নীলকুঠি, সাতক্ষীরার নবরত্ন মন্দির কালিগঞ্জের খানবাহাদুর আহলান উল্লাহর সুদৃশ্য মাজারসহ এ জেলার অসংখ্য প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন এর সাথে জড়িয়ে আছে। খাদ্যদ্রব্য হিসেবে সাতক্ষীরার চিংড়ী মাছ সন্দেশ, বিলাতিকুল, ওল এবং ঘোলের অনেক সুনাম আছে সারাদেশে। সুদূর ঢাকা থেকে ৩শ’ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের তীরে সুন্দরবন উপকূল সীমান্তবর্তী জেলা। সাতক্ষীরা জেলা নানা কারণে সারাদেশের মানুষের নিকট অতিপ্রিয় ও অতি পরিচিত। যে কোন ভ্রমণ বিলাসী সাতক্ষীরায় ভ্রমন করে অনেক কিছু উপভোগ করতে পারে।
Check Also
সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …