সীতাকুণ্ডে শ্বাসরুদ্ধকর ১৮ ঘন্টার অভিযানে ৫ উগ্রবাদী নিহত

ক্রাইমবার্তা রিপোট:সীতাকুণ্ডে উগ্রবাদীদের আস্তানায় শ্বাসরুদ্ধকর ১৮ ঘন্টার অভিযান অবশেষে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পুলিশ এ অভিযানের নাম দিয়েছেন “অ্যাসল্ট সিক্সটিন”। এ অভিযানে এক শিশুসহ ৫ উগ্রবাদী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে তিন উগ্রবাদী আত্মঘাতী বোমায় ও অপর দুজন সোয়াত সদস্যদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এক নারী এবং তার শিশু সন্তানও রয়েছেন। ঢাকা থেকে আসা সোয়ত টিমের একটি চৌকস দল বুধবার গভীর রাতে ছায়ানীড় নামক ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাদে অবস্থান নিয়ে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা থেকে পৌনে ৭টার মধ্যে এ শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটান। বোমা বিশেষজ্ঞ দল আস্তানা থেকে ১২টি গ্রেনেড উদ্ধার করে সেগুলো নিস্ক্রিয় করেছেন। এ অভিযানে সোয়াতের তিন সদস্যও গুরুতর আহত হন।

আহতদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজন হওয়ায় চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত : পৌরসদরের নামার বাজার এলাকায় সুবেশদাশ সুরেশের মালিকানাধীন সাধন কুঠির নামক একটি বাড়িতে গত দুই মাস আগে এক দম্পতি (জসিম উদ্দিন (৩০), ও আনজিনা বেগম (২০) নামে) তাদের এক শিশু সন্তান নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকে। বাড়ির মালিক তাদের গতিবিধি সন্দেহ হলে বুধবার দুপুর ১টার সময় স্থানীয়দের সহায়তায় তাদরেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চৌধুরী পাড়ার প্রেমতলা এলাকায় ছায়ানীড় নামক একটি দ্বীতল ভবনে উগ্রবাদীদের আরো একটি ইউনিট থাকার কথা স্বীকার করে। পুলিশ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিকেল ৩টার সময় পুরো বাড়িটি ঘেরাও করে অভিযানের প্রস্তুতি নিলে উগ্রবাদিরা এসময় পুলিশকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড ছোড়ে মারে।
চূড়ান্ত অভিযান যে ভাবে শুরু : খবর পেয়ে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে এসে মাইকিং করে উগ্রবাদীদের আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু উগ্রবাদীরা আত্মসর্পণ না করে ভবনে থাকা দুইটি পরিবারের ৯ সদস্যকে পণবন্দি করে এ ঘটনার অবসান চায় এবং তাদেরকে নিরাপদে এলাকা ত্যাগ করার সুযোগ দিতে বলেন। উগ্রবাদীদের দাবি নিয়ে ডিআইজি পুলিশের উর্ধ্বতন ও অধঃস্তন কর্মকর্তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত ভবনে সফল একটি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এসময় পুলিশের হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করে জিম্মিদের উদ্ধার ও উগ্রবাদীদের ধরতে সোয়াত সদস্যদের সহায়তা চাওয়া হয়। সোয়াত সদস্যদের বিশজনের একটি চৌকস দল বুধবার রাত ১২টার সময় ঘটনাস্থলে এসে কাজ শুরু করে। সোয়াত সদস্যরা রাত সাড়ে ১২টার সময় ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছাদে অবস্থান করা উগ্রাবাদীর হটিয়ে ভবনটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরো রাত অপেক্ষো করে। এসময় উগ্রবাদীদের সাথে সোয়াত সদস্যদের রাতভর ব্যাপক গোলাগুলি ও থেমে থেমে গ্রেনেড বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। গোলাগুলিতে পুরো এলাকায় চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে সোয়ত সদস্যরা। অভিযান পৌনে ১ ঘন্টা ধরে চলে। এসময় উগ্রবাদীরা টিকতে না পেরে ভবনের সিঁড়ি রোমে গিয়ে আত্মঘাতি বোমার বিষ্ফোরণ ঘটায়। বোমাটি বিকট শব্দে বিষ্ফোরিত হয়।
পুরো অভিযানজুড়ে পুলিশ সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষকে কাছে ভিড়তে না দিলেও সকাল সাড়ে ৯টায় চট্টগ্রাম রেঞ্জেরে ডিআইজি শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল থেকে কিছু দূরুত্বে প্রেমতলা রাস্তার মাথায় এসে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এবং পুরো অভিযানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে “অ্যাসল্ট সিক্সটিন”। সোয়াত সদস্যদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে উগ্রবাদিদের এক মহিলা ও পুরুষ সদস্য আত্মঘাতি বোমার বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদেরকে উড়িয়ে দেন এবং সোয়াত সদস্যদের গুলিতে অন্য দু’জন পুরুষ সদস্য ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তাছাড়া সোয়াত সদস্যরা জিম্মি হওয়া নয় জন ও ভবনে থাকা অপর নারী শিশুসহ মোট একুশ জন সদস্যকে জানালার গ্রিল কেটে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন। তাছাড়া বুধবারে আটক দুই উগ্রবাদি জিজ্ঞাসাবাদে একেবারেই নীরব রয়েছেন। কোন তথ্য দিয়ে আমাদেরকে সহযোগিতা করছেনা। এছাড়া এদেরকে নব্য জেএমবির সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান এক প্রেস ব্রিফিংএ সাত বছরের এক শিশুসহ মোট ৫জন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চত করেন।
সীতাকু- মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ ইফতেখার হাসান বলেন, উগ্রবাদীদের দুইটি কক্ষে বেশ কিছু গ্রেনেড অবিষ্ফোরিত অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা থেকে সিআইডি ও বোমা নিঃস্কৃয়কারীর একটি দল বেলা ১১টায় ঘটনাস্থলে এসে সেগুলো ধ্বংসে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে প্রায় ১২টি গ্রেনেড ধ্বংস করা হয়।
এদিকে পুলিশ ভবনটির আশপাশে কাউকে যেতে না দিলেও বেলা ১২টার সময় সাংবাদিকরা ভবনটির কাছাকাছি যেতে সক্ষম হন। সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আত্মঘাতী বোমার বিষ্ফোরণে সিঁড়ি রুমের ছাদটি উড়ে যায়। আত্মঘাতি বিষ্ফোরনে নিহতদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পুরো ভবনটি যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
ছায়ানীড় নামক বাড়িটির এক বাসিন্দা সোহানা আক্তার বলেন, কখনো এধরনের ঘটার সম্মুখীন হবো কল্পনাই করিনি। পুরো রাত আমরা অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম। একপর্যায়ে বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পুলিশের সফল অভিযানে আল্লাহ আমাদের সবাইকে বাঁছিয়ে দেন।
সীতাকুণ্ড পৌর মেয়র বদিউল আলম আলম বলেন, সীতাকুণ্ড পৌরসভা একটি শান্তিপ্রিয় জনপথ। এখানে এর আগে কোনো জঙ্গির অস্তিত্বের কোনো খবর আমাদের জানা ছিল না। জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে সীতাকুণ্ডকে অশান্ত করার চেষ্টা করেছিল। ইনশাআল্লাহ, পুলিশের সফল অভিযানে সেটি ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত পুলিশ ওই ভবন থেকে উগ্রবাদীদের লাশ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।

Check Also

প্রত্যেক উপজেলায় একটি সরকারি মাদ্রাসা করার সুপারিশ: সাতক্ষীরা ডিসি

ক্রাইমবাতা রিপোট,  সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেছেন, যদি প্রত্যেকটা উপজেলায় একটা সরকারি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।