ক্রাইমবার্তা রিপোট:চট্টগ্রামে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার ১২ ঘণ্টা পর কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর (৪০) হাত-পা বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে কর্ণফুলী নদীর তীরে। বুধবার রাত ১২টার দিকে নগরীর চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরা (পশ্চিম গলি) মিন্নি মহলের বাসা থেকে ১০-১২ জন পুলিশ পরিচয়ে তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যায়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে তার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। লাশের দুই হাত ও পা নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধা ও মুখে কাপড় ঢোকানো ছিল। মাথায় গুলি ও সারা শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিল বের করলে নগর ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ গুলি ছুড়লে ছাত্রদলের অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ছাত্রদল। সংঘর্ষ চলাকালে কাজীর দেউড়ি ও নুর আহমদ সড়কে ২০-৩০টি যানবাহন ভাংচুর করা হয়। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা বিএনপি এবং ছাত্রদল এটিকে ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড’ বলে দাবি করেছে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রোববার চট্টগ্রাম বিভাগে আধা বেলা হরতাল ডেকেছে নগর ছাত্রদল। এ ছাড়া ওইদিন সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। এ হত্যাকাণ্ডকে জঘন্যতম উল্লেখ করে এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। এদিকে লাশ উদ্ধারের পর পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
নিহত ছাত্রদল নেতা নুরুল আলমের ভাগ্নে রাশেদ জানান, বুধবার রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে রাউজান নোয়াপাড়া পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই জাবেদের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন পুলিশ বাসায় আসে। এর মধ্যে ২-৩ জন পোশাকধারী এবং ৮-৯ জন সাদা পোশাকের ছিল। আমার মামাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে জানিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের মোবাইল ফোনও নিয়ে গেছে। রাশেদ জানান, বাসার গেট বন্ধ ছিল। পুলিশ দেয়াল টপকে বাসায় ঢুকেছে। মাত্র এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে মামাকে (নুরু) তারা তুলে নিয়ে গেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। রাউজান পুলিশ কখনোই এটি করতে পারে না। তবে খবর পাওয়ার পর রাউজান থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নুরুর লাশ উদ্ধার করে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক নুরু চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কও ছিলেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নুরু বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তিনি রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের সামালদা পাড়া এলাকার মৃত ইসহাক মিয়ার ছেলে। উন্মে হাবিবা (১০), নাঈমুল আলম নাঈম (৬) ও নুবাইয়েত আলম (৪ মাস) নামে তিন সন্তান আছে। নুরুর বিরুদ্ধে রাউজান থানায় ৮-১০টি মামলা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তবে বিএনপি বলছে, নুরু একজন ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ। তার সব মামলা ছিল রাজনৈতিক।
সরওয়ার নামে নুরুর আরেক আত্মীয় বৃহস্পতিবার জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের ভয়ে নুরু গ্রামের বাড়িতে যেতে পারতেন না। রাউজানে না থেকেও তিনি ৮-১০টি মামলার আসামি হয়েছেন রাউজানের ঘটনায়। সর্বশেষ তাকে খুন হতে হল।
বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, জেলা পুলিশের একটা সশস্ত্র টিম নগরীর বাসা থেকে নুরুকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় রাউজান থানার নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই জাবেদকে পরিবারের সদস্যরা দেখেছেন। তার সঙ্গে জেলা পুলিশের কয়েকজন ইউনিফর্ম পরা এবং বাকিরা সিভিল পোশাকে ছিল। তাকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে শুনেছি। তিনি আরও বলেন, নুরুর বিরুদ্ধে মামলা থাকতে পারে। তাকে গ্রেফতার করা যেত, প্রয়োজনে বিচারের মুখোমুখি করা যেত। কিন্তু স্বাধীন দেশের একজন নাগরিককে পুলিশ রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে মেরে ফেলবে, এটা কেমন দেশ!
তবে নুরুকে গ্রেফতারের অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই জাবেদ বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত থানা ও ফাঁড়ির সব ফোর্স মিলে মগদাই এলাকার কাগতিয়া মুনিরীয়া মাদ্রাসায় জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করি। সেখানে আমিও ছিলাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে নুরুকে আটক কিংবা গ্রেফতার করিনি। আমি তাকে চিনিও না।
রাউজান থানার ওসি কেফায়েত উল্লাহ বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য নুরুকে শহরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় করেনি। হাত বাঁধা অবস্থায় তার লাশ বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট এলাকার কর্ণফুলী নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় লাশ উদ্ধার করে রাউজান থানার এসআই নুর নবী সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেছেন।
রোববার চট্টগ্রাম বিভাগে আধা বেলা হরতাল, সারা দেশে বিক্ষোভ : এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রোববার চট্টগ্রাম বিভাগে অর্ধদিবস হরতালের ঘোষণা দিয়েছে নগর ছাত্রদল। সন্ধ্যায় বিক্ষোভ মিছিল শেষে সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন নগর ছাত্রদল সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহ। তিনি বলেন, নুরু হত্যার প্রতিবাদে রোববার চট্টগ্রাম বিভাগে ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করেছি।
এদিকে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে রোববার সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। সভাপতি রাজীব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান এক বিবৃতিতে এ সমাবেশের ডাকা দেন।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল। বৃহস্পতিবার বিকালে নগরীর নাসিমন ভবনে দলীয় প্রতিবাদ সমাবেশ চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, সরকার বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার যে নীলনকশা তৈরি করেছে এর অংশ হিসেবেই একের পর এক বিএনপির নেতাকর্মীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে। নুরু রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। সভা শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল নাসিমন ভবনের দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে কাজীর দেউড়ি এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। প্রতিবাদ সভায় তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শুক্রবার ও শনিবার প্রত্যেক থানায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ এবং রোববার কাজীর দেউড়ি দলীয় কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ।