প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর মোদির ‘ম্যাজিক’-এর অপেক্ষায় তিস্তা চুক্তি ৫০০ কোটি ডলারের ঋণের ঘোষণা দেবে ভারত * ৩৩ চুক্তি ও এমওইউ সইয়ের সম্ভাবন

নয়াদিল্লি থেকেmodi_43939_1491343535
প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল
 তিস্তা চুক্তি নিয়ে সবাই এখন হায়দরাবাদ হাউসের দিকে তাকিয়ে আছেন। এ ভবনেই শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দু’দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনার আগে দুই নেতা একান্তে কিছু সময় আলোচনা করবেন। তিস্তা নিয়ে কী হবে- তার একটি ফর্মুলা সেখান থেকেই বের হতে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। তবে তাদের মতে, আপাতত মোদির ‘ম্যাজিক’ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। মোদির জাদুকরী ক্ষমতার কথা দিল্লির অনেকেই স্বীকার করেন।
শেখ হাসিনার সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি নৈশভোজের আয়োজন করবেন। এটা প্রণবের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ, সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়া সীমিতসংখ্যক অতিথি থাকবেন। এ আমন্ত্রণে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোনো মুখ্যমন্ত্রীকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে মমতা ব্যানার্জিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে যেসব খবর বের হচ্ছে, তার সত্যতা নিয়ে দিল্লির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো প্রশ্ন তুলেছে। দিল্লিতে এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, তিস্তায় সম্মতি না দিলে একটা নির্ধারিত সময়ের পর মমতাকে বাদ রেখেই চুক্তি সই করতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লির বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরে তিস্তা চুক্তি সই নাও হতে পারে। তবে এ চুক্তি সই করার ব্যাপারে নতুন করে গুরুত্ব অনুধাবনের কথা ব্যক্ত করতে পারেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এমন ক্ষেত্রে চলতি বছরের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সই করার আশা করছেন কেউ কেউ। তিস্তা চুক্তির পুরোটাই নির্ভর করছে হায়দরাবাদ হাউসে শেখ হাসিনা ও মোদির একান্ত আলাপে কী উপায় উদ্ভাবন করেন তার ওপর।এ ব্যাপারে দিল্লিতে একজন বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেছেন, ‘মমতা কিছুতেই রাজি না হলে তাকে ছাড়াই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি সই করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেননা বিদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করার ক্ষমতা কেন্দ্রের রয়েছে। তাছাড়া, উত্তর প্রদেশে বিজয়ের পর মোদি সরকারের এখন শক্তিশালী অবস্থানে আছে।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, মমতা এ বিষয়টি জানেন এবং এ কারণে তিনি ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেস একই আশঙ্কা করছেন।

এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে বিস্তৃত সহযোগিতা চাইছে ভারত। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ কতটা অগ্রসর হবে, সেটা নির্ধারণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ২৫ বছর মেয়াদি সামরিক সরঞ্জাম ও সমরাস্ত্র ম্যানুফ্যাকচারিং এবং প্রোডাকশনের মতো বড় ধরনের চুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ভারতের তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা সফরে গিয়ে তিনি এ প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে। ফলে ভারতের সঙ্গে সামরিক খাতে কতটা সহযোগিতা হবে সেটা নির্ধারণ করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্যদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য খুব সীমিত পরিসরেই আছে। তবে দিল্লির বিস্তৃত প্রস্তাবে ঢাকা কিছুটা কাটছাঁট করে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) আকারে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদিও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার নাম যাই হোক, তার গভীরতা কতটা হবে, সেটা নির্ভর করছে শেখ হাসিনার ইচ্ছার ওপর। ফলে এখনই সেটা স্পষ্ট হচ্ছে না। দিল্লিতে অনেকেই মনে করেন, সার্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় দিল্লির প্রস্তাবে কাটছাঁট করা হতে পারে।

অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে দেশটির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ কোটি ডলারের ঋণের ঘোষণা দেয়া হতে পারে। এই ঋণের অর্থে অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে প্রায় ৩৩টি চুক্তি সই হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈন্য শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্মাননা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে শহীদ হওয়া সাতজনের পরিবারকে শেখ হাসিনা নিজ হাতে সম্মাননা প্রদান করবেন। ভারতের পক্ষ থেকে এই সাতজনের নামের তালিকা বাংলাদেশ সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী এই ভারতীয় সৈন্যরা হলেন ল্যান্সনায়েক আলবার্ট এক্কা, মেজর অনুপ সিং, সুবেদার মালকিয়াত সিং, সিপাহি আনসুয়ে প্রসাদ, লেফটেন্যান্ট সমির দাস, স্কোয়াড্রন লিডার এবি সামান্ত, ল্যান্সনায়েক মোহিনী রঞ্জন চক্রবর্তী। দিল্লিতে সেনানিবাসে অবস্থিত মানেকশ সেন্টারে এই সম্মাননা অনুষ্ঠান হবে। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। এ বিষয়ে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নিজে এসে আত্মত্যাগী সৈন্যদের সম্মান জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১৬৬১ জন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের পরিবারবর্গের কাছে পর্যায়ক্রমে এই সম্মাননা দেয়া হবে।

দিল্লি এখন বিদেশি বিশিষ্ট অতিথিদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের আগমনে দিল্লির রাস্তায় এখন ভারত আর মালয়েশিয়ার পতাকা শোভা পাচ্ছে। নাজিব রাজ্জাকের বিদায়ের পর পরই দিল্লি আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এবার পাঁচজন মন্ত্রী দিল্লি আসছেন। তারা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

শুক্রবার ভারতীয় বিমান বাহিনীর পালাম বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাবেন ভারতের প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। এ সময় দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী উপস্থিত থাকবেন। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে উঠবেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আমন্ত্রণে চারদিনের সফরকালে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি ভবনেই থাকবেন। তারপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। একই দিনে বিকাল ৫টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লির চাণক্যপুরিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন পরিদর্শনে আসবেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। তিনি মাগরিবের নামাজের পর বাংলাদেশ হাইকমিশনের দেয়া নৈশভোজে যোগ দেবেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের দ্বিতীয় দিন সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। তারপর শেখ হাসিনা রাজঘাটে অবস্থিত গান্ধী সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। সেখানে তিনি পরিদর্শন বইয়ে সই করবেন। তারপর হায়দরাবাদ হাউসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সেখানে দুই প্রধানমন্ত্রী একান্ত আলোচনার পর আনুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু হবে। এই বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে। তারপর এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের হিন্দু অনুবাদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বইটির হিন্দি অনুবাদ করা হয়। তারপর শেখ হাসিনাকে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এছাড়া ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারী এবং কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গেও শেখ হাসিনার বৈঠক হবে। শেখ হাসিনা তার সফরের শেষ দিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করবেন। প্রধানমন্ত্রী আজমির শরিফে গিয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) মাজার জিয়ারত করবেন। শেখ হাসিনা দিল্লিতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সম্মেলনেও বক্তব্য রাখবেন।যুগা

Check Also

আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইল বাংলাদেশ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারতকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।