ক্রাইমবার্তা রিপোট:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের ভারত সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬টি সমঝোতা স্মারক ও ছয়টি চুক্তি সই হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের মাত্রা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বলে ধারণা দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং এসব চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের লাভক্ষতি কতটুকু হলো? এমনকি বাংলাদেশের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় এসব চুক্তির কোনো প্রভাব পড়বে কি নাÑ সে ব্যাপারে অভিমত তুলে ধরে নয়া দিগন্তের সাথে খোলামেলা কথা বলেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা সই গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা বলেন, প্রতিরক্ষা বিষয়ে যে সমঝোতা হয়েছে তার অনেক কিছুই অস্পষ্ট। ভারত নিজেই সমরাস্ত্রসামগ্রী আমদানি করে। এখন তারা যদি বাংলাদেশকে অস্ত্র সরবরাহের প্রস্তাব করে তাহলে সেটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য ও নির্ভর করার মতো, তা সময়ই বলে দেবে। এটা কখনোই জাতীয় স্বার্থের অনুকূল হবে না। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তারা বলেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হলে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর পূর্ণতা লাভ করত। কিন্তু সেই চুক্তি হয়নি। চুক্তি ও সমঝোতাগুলোকে প্রাসঙ্গিক করতে হলে তিস্তাচুক্তি অবশ্যই দরকার। তা না হলে জনগণের মাঝে হতাশা দেখা দেবে
। কেউ কেউ বলছেন, তিস্তাচুক্তি করতে না পারায় প্রধানমন্ত্রীর সফর সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।
এমাজউদ্দীন আহমদ : প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, চীন থেকে দু’টি সাবমেরিন ক্রয় এবং রাশিয়া থেকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের পর থেকেই ভারত ভিন্ন চোখে বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করে। বিষয়গুলো এমনভাবে সামনে নিয়ে আসা হয় যাতে বাংলাদেশের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। এতে ভারতের কাছে বাংলাদেশের যেসব দাবি ছিল সেসব কিন্তু হারিয়ে গেল। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান।
তিনি জানান, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি। কিন্তু এ নিয়ে ভারত আমাদের আশার বাণী শুনিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ করার দাবি ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সফরে এ নিয়েও কোনো কথা হয়নি।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশের পাট শিল্পে অ্যান্টি ডাম্পিং আরোপ করেছে। এতে আমাদের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসলটি ক্ষতির সম্মুখীন। এ নিয়েও কোনো কথা হয়নি। তা ছাড়া ব্যবসায় ট্যারিফ-নন ট্যারিফ বাধা নিয়েও কোনো কথা হয়নি।
প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের ঋণ প্রদান সমঝোতার ব্যাপারে বরেণ্য এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, আশ্চর্য হলো ভারত বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা খাতে ঋণ দেবে এবং ভারত থেকেই অস্ত্র কিনতে হবে। কিন্তু তারাই তো ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক অস্ত্র ক্রয় করে। এখন ভারতীয় অস্ত্রের মান কেমন হবে? সেগুলো কেবল সামরিক বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লাভবান হয়নি। কারণ ভারত থেকে অস্ত্র কিনলে আবার তাদের কাছে সামরিক প্রশিক্ষণের বিষয়টিও জড়িয়ে যায়। সুতরাং এসব বিষয় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ।
মাহবুবুর রহমান : সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মাহবুবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর সম্পর্ক ভালোই চলছিল। এখন নতুন করে চুক্তি বা সমঝোতা সই হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে দেখার বিষয় হলো দেশের কোনো ক্ষতি হয় কি না।
প্রতিরক্ষা সমঝোতা প্রসঙ্গে তিনি জানান, দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ হতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতা সই ছাড়াই তো সম্পর্ক ভালো চলছিল। এখন কী এমন হলো যে প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য নতুন করে সমঝোতা করতে হলো?
ভারতের কাছ থেকে তাদের ঋণে সমরাস্ত্র ক্রয় করা প্রসঙ্গে মাহবুবুর রহমান বলেন, এমনিতেই ভারতের সমরাস্ত্র মানসম্মত নয়। এখন মোটা অঙ্কের ঋণের টাকায় তাদের থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করতে হবে এমন কোনো বাধ্য বাধ্যকতা নেই। কারণ চুক্তি হলে দুই দেশের মাঝে জবাবদিহিতার ব্যাপার থাকে। আর সমঝোতা হলো কোনো বিষয়ে সমর্থন বা সহায়তার আশ্বাস। এ ক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মনে করে ভারতীয় সমরাস্ত্র মানসম্মত নয়, তারা না কিনলে কোনো বাধ্যকতা নেই বলে আমি মনে করি।
তবে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সফর সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ পানির অপর নাম জীবন। এখন মমতা ব্যানার্জি বলছেন, তিস্তায় পানি নেই। কিন্তু তারা তো পানি ব্যবহার করছে। সেখান থেকে বাংলাদেশকে দেয়া হোক।
দেলোয়ার হোসেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারতের সাথে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই হলে প্রধানমন্ত্রীর সফর পূর্ণতা পেত। কিন্তু সেই চান্স খুবই কম। কারণ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সম্মতি না থাকায় তা হয়নি। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তাচুক্তির ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন।
তিনি জানান, ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন নতুন পরিপ্রেক্ষিতে। আবার চীন ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে এ নিয়ে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয় সে জন্যই প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফর। তিস্তার পানিচুক্তি না হলেও এই সফরে অনেক অর্জন আছে বলে তিনি মনে করেন।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে সমঝোতা হয়েছে। এ অর্থ দিয়ে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করবে বাংলাদেশ। যদিও ভারত কোনো অস্ত্র রফতানি করে না। কারণ তাদের সামরিক সরঞ্জাম আমদানিনির্ভর। তবে তারা সরঞ্জাম দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারকে কোনো শর্ত না থাকলেই হলো। তাহলে অন্যত্র থেকে সরঞ্জাম ক্রয় করা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বাংলাদেশের লাভ কতটুকু? জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. দেলোয়ার হোসেন জানান, নিঃসন্দেহে সফরটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে সহজে লাভ-ক্ষতি নিরূপণ করা যায় না। কেননা প্রতিটি সফর এবং চুক্তিতেই বাস সার্ভিস, বিদ্যুৎ সঞ্চালন, পরমাণু চুক্তি, মহাকাশ ব্যবহারের মতো বিভিন্ন বিষয় সম্পৃক্ত রয়েছে। এর দ্বারা মূলত দুই দেশের দূরত্বকে বিশ্লেষণ করা যায়। কেননা চীনের সাথে সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশের ওপর একটা চাপ আছে।
সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণে ভারতের সহায়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের (এনডিসি) নিজস্ব কিছু প্রোগ্রাম থাকে। এখন যদি এনডিসি থেকে একটি নতুন কোর্স করে ভারতে প্রশিক্ষণ বা ওয়ার্কশপের জন্য একটি টিম যায় সেটা তো খারাপ কিছু না। তবে সমঝোতার বিষয়গুলো বিস্তারিত না জানলে এ ব্যাপারে কথা বলা মুশকিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মহাকাশ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে কি নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক দেলোয়ার জানান, মহাকাশ ব্যবহারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তবে তিস্তাচুক্তিটা ছিল বেশি জরুরি। ইতোমধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতাগুলোকে প্রাসঙ্গিক করতে হলে তিস্তাচুক্তি অবশ্যই দরকার। তা না হলে দেশের জনগণের মাঝে হতাশা দেখা দেবে। এখন দেখা যাক তিস্তাচুক্তি হয় কি না? যেহেতু নরেন্দ্র মোদি আশ্বাস দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ক গাঁটছড়া বাঁধার একটা কথা বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আসলে যখনই যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের সাথে সম্পর্ক মজবুত হবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখলে চলবে না।
আ ল ম ফজলুর রহমান : সাবেক বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) আ ল ম ফজলুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, গণমাধ্যম সূত্রে যা জেনেছি, বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিশাল অঙ্কের সহায়তা, মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, ভারতীয় নৌ-চলাচল বিষয়ে সহযোগিতা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা ও চুক্তি হয়েছে। এতে মনে হলো সবকিছু ভারতেরই বেশি দরকার ছিল। বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল তিস্তার পানি। এ ব্যাপারে তো কোনো কথা হয়নি। বরং অভিন্ন আরো চারটি নদীর ব্যাপারে কথা হয়েছে। কিন্তু তিস্তার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কোনো কথা বলেননি। তাহলে এসব চুক্তি আমরা কেন করতে গেলাম? আমরা কিসের বিনিময়ে ভারতকে এসব দিলাম? এখানে তো আমাদের কোনো লাভ দেখছি না।
তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় ভারত আসুক এটা তো আমরা চাইনি। আশির দশকে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমি ট্রেনিং (বিএমএটি) মিরপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনের কমান্ডার প্রশিক্ষণ দিত। ভারত ছাড়াও বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সামরিক বাহিনীর ব্যক্তিরা আসতেন। এখানে ভারত কেন ঢুকবে?
চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সাবেক এই সেনাকর্মকর্তা আরো জানান, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আর সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চালু রেখে এসব বাস্তবায়ন করা যাবে না। সমস্ত চুক্তিই অপ্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের চার দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জেলখানা করে রাখা হয়েছে, তো আবার বন্ধুত্ব কিসের? এখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী হিন্দিতে অনুবাদ করল সেটা তো রাষ্ট্রীয় ব্যাপার না। আসলে চীন থেকে সাবমেরিন কেনার পরই ভারতের মাথা খারাপ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আ ল ম ফজলুর রহমান।
সামরিক সরঞ্জামাদি ভারত থেকে ক্রয় করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কিনে আসছে। এখন নতুন করে ভারত থেকে কেন? অস্ত্র কেনার প্রয়োজন হলে থার্ড পার্টির প্রয়োজন নেই। আমরা রাশিয়া থেকেই অস্ত্র কিনতে পারি।