ক্রাইমবার্তা রিপোট:গাজীপুর সংবাদদাতা, ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষনেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুলের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করার জন্য মঙ্গলবার স্বজনদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। রাষ্ট্রপতির কাছে করা দন্ডপ্রাপ্ত ওই দু’জনের প্রাণ ভিক্ষার আবেদনের (মার্সি পিটিশন) নাকচ হওয়ার পর বিধি মোতাবেক এ বার্তা পাঠানো হয়। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত স্বজনদের কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কাশিমপুরের এ কারাগারে আসেন নি বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এদিকে বিধি মোতাবেক তাদের ফাঁসির দন্ড কার্যকরের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। এখন সরকার স্থান ও দিনক্ষণ ঠিক করে যে কোন মুহুর্তে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দিলেই তা বাস্তবায়ন করবে কারা কর্তৃপক্ষ। এই দুই জঙ্গির ফাঁসিকে কেন্দ্র করে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলগেইট ও আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার মিজানুর রহমান জানান, সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে হত্যাচেষ্টা মামলায় মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী হরকাতুল জিহাদ (হুজি) এর শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুল আদালতে মৃত্যুদন্ডের রায়ের রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে গত ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন (মার্সি পিটিশন) করেন। পরে তা স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়। সম্প্রতি ওই আবেদন নাকচ করেন রাষ্ট্রপতি। তাদের আবেদনের রিজেক্ট কপি সোমবার কারাগারে পৌঁছে। প্রাণভিক্ষা নাকচের চিঠির সঙ্গে ফাঁসি কার্যকরের ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনাও এসেছে। প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার খবর সোমবারই তাদের জানানো হয়েছে। মুফতি হান্নান ও বিপুলের ফাঁসি কার্যকরে সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে কারা প্রশাসন। অপরদিকে তাদের সঙ্গে কারাগারে শেষবারের মতো দেখা করতে মঙ্গলবার সকালে স্বজনদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত তাদের স্বজনদের কেউ কারাগারে দেখা করতে আসেননি। এদিকে তাদের ফাঁসি কার্যকরের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ। ফাঁসির মঞ্চ, মৃত্যু কুপ ও ফাঁসি কার্যকরের জন্য বিশেষ ধরনের ম্যানিলা রশি সবকিছুই প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দন্ড কার্যকর করতে জল্লাদ রাজু প্রস্তুত রয়েছে। এরই মধ্যে মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন নিয়ম মাফিক যেকোন সময়ে ওই দুই জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তবে কবে কখন তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে চাননি কারা কর্মকর্তা। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান ও বিপুল গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অপর আসামি দেলোয়ার হোসেন রিপন সিলেট জেলা কারাগারে ফাঁসির সেলে বন্দি রয়েছেন।
এদিকে, কাশিমপুর কারাগারে দুই জঙ্গির ফাঁসিকে কেন্দ্র করে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে জেলগেইট ও আশেপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিকেলে কারাগার এলাকা পরিদর্শন করেন গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এসময় তিনি বলেন, মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী বিপুলের ফাঁসির রায় কার্যকর করা নিয়ে আমরা প্রস্তুত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ কারাগার এলাকায় কাজ করছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
কারা সূত্র জানায়, এদের মধ্যে প্রথম দু’জনের কাশিমপুরে এবং অন্যজনের সিলেটে ফাঁসির দন্ড কার্যকর করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা সরকারের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন (মার্সি পিটিশন) নাকচ হওয়ার পর ওই প্রাণভিক্ষার আবেদন করার দিন থেকে ২২দিনের কম নয় এবং ২৮দিনের বেশি নয় এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসির দন্ড কার্যকর করার বিধান রয়েছে।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার মামলায় মৃত্যু দন্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ায় অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনাই ছিল এই তিন জঙ্গির আইন অনুযায়ি বাঁচার শেষ সুযোগ।
এদিকে দন্ডপ্রাপ্তদের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করার জন্য স্বজনদের কাছে পাঠানো কারাকর্তৃপক্ষের বার্তার খবর পেয়ে সংবাদ কর্মীসহ সকলের মাঝে ধারণা করেন মঙ্গলবার রাতের মধ্যে ওই দু’জঙ্গীর ফাঁসির রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের জন্য সংবাদকর্মীরা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার এলাকায় ভীড় জমাতে শুরু করেন। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যেকোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ওই উপস্থিত হন।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। মামলার রায়ে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত পাঁচ আসামির মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদন্ড এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলকে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং দেলোয়ার হোসেন রিপনকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদন্ড অনুমোদন করতে প্রয়োজনীয় নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি ২০০৯ সালে আসামিরা জেল আপিলও করেন। পরে প্রায় ৭ বছর পর গত বছরের ৬ জানুয়ারি এ মামলায় হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। বিচারিক আদালতের দন্ড বহাল রেখে ১১ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। গত বছরের ২৮ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। ১৪ জুলাই আপিল করেন দুই আসামি হান্নান ও বিপুল। অন্য মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি রিপন আপিল না করলেও আপিল বিভাগ তার জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ করেন। আপিলের শুনানি শেষে চুড়ান্ত রায়ে গতবছরের ৭ডিসেম্বর তিন আসামির সর্বোচ্চ রায় বহাল রাখে। গত ১৭ জানুয়ারি এ রায় প্রকাশের পর আসামিরা রিভিউ করেন। পরে ১৯ মার্চ দেয়া রিভিউ খারিজের রায় গত ২১ মার্চ প্রকাশিত হয়। রিভিউ খারিজের ২১ মার্চ রায়ের কপি রাত পৌণে ১২টার দিকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। পরদিন বুধবার সকাল ১০টার পর তা মুফতি হান্নান ও বিপুলকে পড়ে শুনানো হয়। এছাড়া ওইদিন সিলেট কারাগার থেকে আসা মৃত্যু পরোয়ানাটিও ওই দিন রাতে তাদের পড়ে শুনোনো হয়েছে।
এছাড়াও রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় দিয়েছে বিচারিক আদালতে। ওই মামলায় তার আপিল হাইকোর্টে বিচারাধীন। এই হুজি নেতার বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। ২০০০ সালের ২০ জুলাই সেই কোটালীপাড়াতেই শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। মুফতি হান্নান ওই মামলারও আসামি। গত ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুফতি হান্নান আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে আহত হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হরকাতুল জিহাদে যোগদান করেন।
রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার আসামি হুজি নেতা মুফতি হান্নানকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রথম কোন মামলায় মৃত্যুদন্ড হতে যাচ্ছে।