লোকাল বাস বনাম মেয়েদের ‘স্যান্ডউইচ লাইফ’

ক্রাইমবার্তা রিপোট:‘ভাই, এটা কী সিদ্ধান্ত হল, কেন হল, কিছুই তো বুঝলাম না। চাকরি-বাকরি দূরে থাক, চলাফেরা করাই তো এখন দায়। বাসগুলো এমনিতে মহিলাদের নিতে চায় না। নিলেও ওঠা যায় না।

ধাক্কাধাক্কি ও ঠেলাঠেলির ৩য় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হয়ে উঠতে হয়। উঠে আবার সিট নেই। সাধারণ সিট তো কেউ ছাড়েই না। মহিলা সিটেও অনেক সময় পুরুষ বসে থাকে। ছাড়তে বললেই তর্কাতর্কি, হইচই।

এদিকে দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। শাড়ি পরলে তো আরও বিশ্রী দশা। তার ওপর বাজে চাহনি। বাজে মন্তব্য। সঙ্গে গা-ঘেঁষা, বিচিত্র ছুতায় গায়ের ওপর পড়ার চেষ্টা। প্রায় প্রতিদিনই বলতে হয়, ভাই একটু সরে দাঁড়ান।

সেটা বলতে গেলে আরেক দফা কথা কাটাকাটি। ওদিকে আবার ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে দুশ্চিন্তা। সারাক্ষণ ব্যাগ থেকে টাকা, মোবাইল চুরির ভয়। তার ওপর ঠেলে ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দেয়।

পেছনে গেলে আবার নামা যায় না। এজন্য ৪র্থ বিশ্বযুদ্ধ করা লাগে। সব মিলিয়ে এক নাভিশ্বাস অবস্থা। ওই অবস্থায় সিটিং সার্ভিস ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। টাকা বেশি, যত্রতত্র দাঁড়ানো-যাত্রী তোলে। তারপরও নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো। উঠলে বেশিরভাগ সময় অন্তত সিটটা পাওয়া যেত। তাছাড়া অস্বস্তি বা নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগতাম না। সিটিং বাস বন্ধ হওয়াতে এখন সেই সামান্যতম স্বস্তিও লাপাত্তা।

প্রতিদিন অফিসে দেরি। বাসায় ফিরতে ফিরতে আবার ৯-১০টা। সিটিং বাসগুলোর অনিয়ম দূর হোক সেটা আমরাও চাই। কিন্তু সরকার চাইলে মহিলা বাস সংখ্যা বাড়িয়ে কাজটা করতে পারত। কিংবা অন্যভাবে সমাধান করতে পারত। তা না করে এভাবে আমাদের জীবনটা স্যান্ডউইচ বানানোর মানে কী? ‘সিটিং বাস’ বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভে এভাবে আগুন ঝরালেন একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা সাদিয়া মিলি। এই আগুন এখন লাখো সাদিয়ার কণ্ঠে।

অবশেষে যাত্রীদের জিম্মি করে সিটিং সার্ভিসের বৈধতা আদায় করেছেন পরিবহন মালিকরা। আসলে এটি ছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কারসাজি। সিটিং সার্ভিস সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা হল, নামে ‘সিটিং’; কাজে ‘চিটিং’। ১৫ এপ্রিল সিটিং সার্ভিস বন্ধ হওয়ার পর থেকে ওই চিটিং যেন চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে গেছে। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধের উদ্যোগে ওই নৈরাজ্য যেন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ আকার ধারণ করেছে।

সিটিং সার্ভিসগুলো লোকাল নাম নিয়ে একদিকে যেমন লোকাল-স্টাইলে বাসে গাদা-গাদা যাত্রী নিচ্ছে; অন্যদিকে ‘সিটিং-স্টাইলে’ দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া নিচ্ছে। অসহায় যাত্রীদের গলা কাটছে। এ যেন ‘আগারটাও খাও, তলারটাও কুড়াও’ ফর্মুলা। সিংহভাগ বাস বিআরটিসির ভাড়ার তালিকাও মানছে না। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল, ‘লোকাল’-এর ছুতোয় যত্রতত্র, যখন-তখন অকারণে গাড়ি থামচ্ছে। যাত্রী তুলছে। যখন ইচ্ছা রুট বদলাচ্ছে। মোবাইল কোর্টের ভয়ে সিংহভাগ সিটিং বাস এখন গ্যারেজে। তাতে এই গরমে কাক্সিক্ষত বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে যাত্রীরা রীতিমতো ‘চিকেন তন্দুরি’ হয়ে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভোগান্তি ও হয়রানি অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকেছে।

আর তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও বেকায়দায় পড়েছে ব্যক্তিগত গাড়িহীন কর্মজীবী মহিলা ও ছাত্রীরা। তাদের রাস্তায় না নেমেও উপায় নেই, আবার নামলে ‘ছেড়ে দে, কেঁদে বাঁচি’ দশা।

নারী সংগঠনগুলো ও সচেতন মহিলাদের অভিমত, মহিলা বাস বাড়ালেই সব সমস্যা মিটে যায়। আসলে কী তাই?

প্রকৃতপক্ষে মহিলাদের এই ধরনের ভোগান্তি ও অস্বস্তি থেকে মুক্তির বারতা নিয়েই ১৯৮০ সালে ‘মহিলা বাসের’ উদ্ভব। এক রুটে মাত্র ৪টি বাস নিয়ে যাত্রা। কিন্তু ফল এলো নেতিবাচক। তাতে কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে গেল সার্ভিসটি। ১৯৯৭ সালে আবার পুনঃচালু। এবার কর্মজীবী মহিলা ও ছাত্রীরাই যাত্রী। পরের বছর যোগ হল মহিলা পোশাক শ্রমিক। কিছুদিন পর যথারীতি এবারও বন্ধ। ২০০১ সালে নব-নির্বাচিত সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে আবার রাস্তায় নামাল মহিলা বাস। ২০০৪ সালে বাসের সংখ্যা দাঁড়াল ২২-এ। কিন্তু অব্যবস্থাপনা ও অযত্নে সংখ্যাটি শিগগিরই ১১-তে নেমে এলো।

গত বছর মার্চে নতুন উদ্যমে আবার ওই বাস চালু হল। কাগজ-কলমে ঢাকার ১৩টি রুটে বর্তমানে ১৫টি মহিলা বাস (৬টি দ্বিতল ও ৯টি একতলা) চালু আছে। তাতে যাত্রী ধারণক্ষমতা মাত্র ৯১৮।

অথচ সাধারণ বাসগুলো চলে ৭৪টি রুটে। বাস্তবতা হল, সকাল-বিকাল দুই বেলা অফিস টাইম ছাড়া অন্য সময়ে এই বাসগুলো উধাও। তাও আবার নিয়মিত নয়।

তারপরও অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় সার্ভিসটি বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ সার্ভিসের অবস্থা এতটাই বেহাল যে, অগণিত মহিলা জানেই না, মহিলা বাস নামে একটা জিনিস রাস্তায় আছে।

বিপরীতে বিআরটিসির যুক্তি হল, এটা অলাভজনক সার্ভিস। কারণ খোদ মহিলারাই ‘মহিলা বাসে’ চড়ে না। বেশিরভাগ সময়ই বাসগুলো খালি যায়। তাতে চালক-হেলপারের বেতন দূরে থাক, তেলের পয়সাও উঠে না। তাছাড়া, মহিলা চালক ও হেলপার মেলানোও দুষ্কর। অনুসন্ধানে বিআরটিসির কিছু কারণও আবিষ্কার করেছে। যেমন- বাসগুলো সারাদিনে দুই বার ও সীমিত কয়েকটি রুটে চলাচল করে।

‘চাহিবামাত্র’ মহিলা বাসের সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ মহিলার সঙ্গে স্বামী-ছেলে বা অন্য পুরুষ থাকে। তাদের নিয়ে মহিলা বাসে ওঠার সুযোগ নেই। তাছাড়া গণমাধ্যমে এ নিয়ে তেমন প্রচার নেই। তাতে মানুষ এই বিশেষায়িত সেবা ও তার সময়সূচি সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ।

মহিলাদের পরিবহন সমস্যাটা একদিনের নয়। এক্ষেত্রে মহিলা বাস কার্যকর অর্থে মোক্ষম ভূমিকা নিতে পারে, যদি সার্ভিসটির বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা দূর করা যায়। এটা ঠিক, সব রুটে ২৪ ঘণ্টা মহিলা সার্ভিস চালুর কাজটা রাতারাতি সম্ভব নয়। তার জন্য ১ বছর, ২ বছর ও ৩ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করা যেতে পারে। প্রচারের জন্য টেলি-প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি মোবাইল কোম্পানি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা যেতে পারে। মোবাইলের কল্যাণে ‘উবার’-এর মতো অপরিচিত সার্ভিস যেমন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমনি মহিলা বাস সার্ভিস, রুট, সময়সূচি ও সুবিধাদিও মোবাইলে প্রচার করা যেতে পারে।

এসব টেকসই কিন্তু সময়সাপেক্ষ সমাধান। আপাত সমাধানটা কী? হ্যাঁ, মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা তো সমাধান নয়। আগে মাথাব্যথার কারণটা জানতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

একই প্রক্রিয়ায় সিটিং সার্ভিসের সমস্যা হল- অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যত্রতত্র যাত্রী তোলা, দাঁড়ানো-যাত্রী তোলা ইত্যাদি। এসব সমস্যা বিদ্যমান আইনে সমাধান সম্ভব। বিআরটিএর তথ্যানুসারে ১৫ এপ্রিল, অভিযানের প্রথম দিনে ঢাকার ৫টি পয়েন্টে ৫ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। ওই এক দিনেই মোটরযান বিদ্যমান আইনে ১২০টি মামলা হয় এবং ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। কারাদণ্ড দেয়া হয় ৪ জনকে। জব্দ করা হয় ৩টি গাড়ি। অভিযানের ভয়ে ওই দিন ৬০ ভাগ সিটিং গাড়ি রাস্তায়ও নামেনি।

(কালের কণ্ঠ-১৭ এপ্রিল, ২০১৭)। অভিযানে যে কাজ হয়, এই তথ্যগুলো তার প্রমাণ। আরও বড় পরিসরে এই অভিযান প্রতিদিন চললে সিটিং সার্ভিসের অনিয়ম ও নৈরাজ্য অনেকটাই কমে আসবে। তাতেও কাজ না হলে প্রয়োজনে এজন্য বিশেষ নীতিমালা বা বিধি প্রণয়ন করে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

ঘরে-বাইরে, আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের আজ দীপ্ত পদচারণা। দেশের আর্থ-সামাজিক, শিক্ষাসহ সর্ব খাতে অবদানে নারী আজ পুরুষের সমকক্ষ। তাই দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের স্বার্থে নারীদের জন্য সহজ ও নিরাপদ যাতায়াত বা ভ্রমণ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি।

সিটিং বাস নিয়ে অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে যে স্যান্ডউইচ জীবন নারীদের ঘাড়ে চেপে বসেছে, তা থেকে নারীদের অবিলম্বে মুক্ত করা দরকার। সরকার চাইলে সেটা অসম্ভবও নয়। তবে চাওয়াটা হতে হবে ঐকান্তিক ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট

 

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।