২৫ দিন পরে মায়ের কোলে শিশু সুমাইয়া চোখে পানি মুখে হাসি নিয়ে মেয়েকে আদরে ভরিয়ে দিলেন মা

ক্রাইমবার্তা রিপোট:কামরাঙ্গীর চরের বড়গ্রামের ছোট্ট শিশু সুমাইয়া। এলাকার সবার কাছে আদুরে পাঁচ বছরের শিশুটি। অপহরণের শিকার হয়ে প্রায় একমাস মা-বাবা ছেড়ে কেটেছে তার জীবন। গত ২ এপ্রিল নিজ বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় শিশুটি।
পরিচিত অপরিচিত নানা জায়গায় খোঁজ করেও সন্তানের কোনো খোঁজ না পেয়ে কামরাঙ্গীর চর থানায় অপহরণের মামলা করেন সুমাইয়ার বাবা। তদন্তে নামে পুলিশ। এক পর্যায়ে আজ ভোররাতে রাজধানী জুরাইনের একটি বাসা থেকে সুমাইয়াকে উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর শিশুটিকে তুলে দেয়া হয় পরিবারের কাছে।

 

 

দীর্ঘ ২৫ দিন পরে বাবা-মায়ের কোলে ফিরলো ফুটফুটে শিশু সুমাইয়া। এক মাত্র সন্তানকে কাছে পেয়ে চোখের পানি, মুখে হাসি নিয়ে মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন মা। আর মায়ের পাশে দাড়িয়ে কাঁদছিলেন শিশুটির বাবা।

আজ ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন এক আনন্দ-বেদনার দৃশ্য চোখে পড়ে। আর শিশু সুমাইয়া মায়ের কোলে বসে উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বার বার বলছিল ‘থ্যাঙ্ক ইউ পুলিশ আঙ্কেল’।
মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত পুলিশ, সাংবাদিকসহ সবাইকেই ছুঁয়ে যাচ্ছিল শিশুটির এ আবেগমাখা উচ্ছ্বাস।

শিশুটিকে অপহরণের অভিযোগে সাবিনা আক্তার বৃষ্টি (২৮) ও তার বাবা সিরাজুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মিডিয়া সেন্টারে তাদের হাজির করা হলেও কিছু বলতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে বিকেলে গ্রেফতার বৃষ্টি ও সিরাজ আর শিশু সুমাইয়াকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় বিচারক প্রণব কুমার হুই শিশুটিকে তার বাবা-মায়ের কাছে তুলে দেন। এছাড়া শিশু সুমাইয়াকে অপহরণের মামলায় সাবিনা আক্তার বৃষ্টি ও তার বাবাকে তিনদিনের রিমান্ড দেন আদালত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কামরাঙ্গীচর থানার এসআই রাজিবুল ইসলাম আসামি বৃষ্টি ও তার বাবা সিরাজ মিয়া ওরফে বাবুলকে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক এ আবেদন মঞ্জুর করেন। শুনানির সময় আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।

এ সময় বিচারক আসামি বৃষ্টির কাছে প্রশ্ন করেন, কেন সুমাইকে অপহরণ করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, আমার সাথে তাদের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। এরপর আর কোনো কথা বলেননি বৃষ্টি। বৃষ্টির কাছে বিচারক আরো জানতে চান, সুমাইয়াকে কোনো মারধর করা হয়েছে কি-না। উত্তরে তিনি জানান, মারধর করা হয়নি।

পুলিশ জানায়, সুমাইয়ার পরিবার যে বাসায় ভাড়া থাকে সেখানে আগে ভাড়া থাকতো বৃষ্টি। ঘটনার দিন বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করার কথা বলে বাসায় আসে বৃষ্টি। এরপর থেকেই নিখোঁজ হয় সুমাইয়া। কি উদ্দেশে সুমাইয়াকে অপহরণ করা হয়েছিলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানায় পুলিশ।

এদিকে সংবাদ সম্মেলনের সময় মায়ের কোলে বসে সুমাইয়া কিছুক্ষণ পরপরই বলছিল, মা, আমাকে চুমু দেও। তখন চোখে অশ্রু, মুখে হাসি নিয়ে মেয়েকে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলেন মা মুন্নি বেগম। আদর পেয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে শিশুটি বলছিলো, আমি অনেক কেঁদেছি মা তোমাদের জন্য। কিন্তু বৃষ্টি আমাকে মেরেছে। ভালোভাবে খেতে দেয়নি। মাঝে মধ্যে মেরেছে আমায়। আটকে থাকার দিনগুলোতে বৃষ্টিকে মা বলে ডাকার জন্য জোর করা হতো বলে জানায় মেয়েটি। এ সময় শিশুটির কথা শুনে ফের ডুকরে কেঁদে ওঠেন বাবা-মা।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি মাহাম্মদ ইব্রাহীম খান তুর্য বলেন, বৃষ্টির ভারতে যাওয়া আসা আছে। এ পর্যন্ত সে তিন চার বার ভারতে গিয়েছে। সে কেনো সুমাইয়াকে নিয়ে গিয়েছিল তার সঠিক জবাব পাওয়া যায়নি। আমাদের তদন্ত কার্যক্রম অব্যহত আছে। আমরা নিশ্চয়ই এটার মোটিভটা কি তা অচিরেই উদ্ঘাটন করতে পারবো।

কামরাঙ্গীর চর থানার ওসি শাহীন ফকির সাংবাদিকদের বলেন, ভোরে রাতে যখন সুমাইয়াকে মা-বাবার কোলে তুলে দেয়া হলো, তখন তারা কাঁদছিলেন। এখন তো অনেকটা স্বাভাবিক।

শিশুটি সাংবাদিকদের জানায়, বৃষ্টি আগেও আমাদের বাসায় এসেছে। প্রায়ই আমাকে তার বাসায় নিতে চাইত। ওইদিন বিকেলে বৃষ্টি আমাদের বাসায় আসে। মা ঘরে ছিল। পরে আমাকে হাত ধরে রাস্তায় নিয়ে গেল।

চিৎকার দিলে না কেন- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে সুমাইয়া বলে, দিতে তো চাইছিলাম, কিন্তু আমাকে রিকশায় তুলে চেপে ধরে রাখছিল।

মা মুন্নি বেগম বলেন, বৃষ্টিরা একসময় তাদের প্রতিবেশী ছিল। সে সুবাদে পরিচয়। ওইদিন বিকেলে বৃষ্টি আমাদের বাসায় এসে বলে, বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করবে। সে আমাদের বারান্দায় ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি সে নাই, সুমাইয়াও নাই।

শিশুটির বাবা জাকির হোসেন বলেন, সুমাইয়া অপহরণের পর থেকে আমার কাছে কেউ মুক্তিপণ চেয়ে ফোনও করেনি। বাচ্চাকে অনেক জায়গায় খোজাখুজির পরে থানায় মামলা করি।

তিনি বলেন, আমার মতো যাতে কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়।

এ সময় তিনি পুলিশ প্রশাসনসহ সবার কাছে সন্তুষ্টি কামনা করেন।

পুলিশের লালবাগ জোনের এডিসি মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান বলেন, প্রযুক্তি ও সোর্সের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি অপহরণকারী ওই নারী কদমতলী থানা এলাকায় অবস্থান করছে। পরে ওই এলাকায় ব্লক রেইড দিয়ে গভীর রাতে জুরাইনের রহমতবাগের একটি বাড়ি থেকে শিশু সুমাইয়াকে উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি অপহরণের সাথে জড়িত বৃষ্টি নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রের সদস্য। তিনি গত কিছুদিনের মধ্যে কয়েকবার ভারত গিয়েছিলেন বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। অপহৃত শিশু সুমাইয়াকেও সময়-সুযোগ বুঝে ভারতে পাচার করা হতো বলে আমরা মনে করছি। তবে তার আগেই শিশুটিকে উদ্ধার করতে পেরেছি।

গত ২ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে বাসার সামনের রাস্তা থেকে নিখোঁজ হয় স্থানীয় একটি কারখানার কর্মী জাকিরের মেয়ে সুমাইয়া। ওইদিনই থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন জাকির। এরপর পরের দিন তিনি কামরাঙ্গীরচর থানায় অপহরণের মামলা করেন।

বড়গ্রামে জাকিরের বাসার তিন বাড়ি পরেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার মোহাম্মদ হোসেনের বাসা। ওই বাড়ির সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে কালো বোরকা পরা এক নারীকে শিশুটির হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

 

Check Also

ক্ষমতায় গেলে নারীদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে জামায়াত : ডা. শফিকুর রহমান

ক্ষমতায় গেলে নারীদের সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে জামায়াত মন্তব্য করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।