বিএনপির দুর্গে হানার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ, বাধা রক্তাক্ত কোন্দল

স্টাফ রিপোর্টার, নোয়াখালী থেকে | ২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার,

নোয়াখালীর রাজনীতির এটা ছিল চেনা দৃশ্য। নোয়াখালী মানে ছিল বিএনপির দুর্গ। একের পর এক সংসদ নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনের ভরাডুবির মধ্যেও নোয়াখালীর বেশিরভাগ আসনে জয়ী হয়েছিল বিএনপি।
সেই সময় অবশ্য এখন আর নেই। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। স্বাভাবিকভাবেই জেলার সংসদীয় আসনগুলো গেছে সরকারি দলের পকেটে। যদিও জেলার ছয়টি আসনের কেবল একটি আসনেই ভোটের প্রয়োজন পড়ে। বাকি ৫ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। এর পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের বেশিরভাগ পদেই ভোটে জয়ী হন আওয়ামী লীগের নেতারা। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ৬টি উপজেলা ও ৭ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ৮৯টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সিংহভাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দখলে। পুরো জেলার রাজনীতিই এখন দৃশ্যত সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্যও পুরোদমে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন দলের নেতারা। তবে নোয়াখালীতে বিএনপির দুর্গ দখলে আওয়ামী লীগের জন্য প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে দলীয় কোন্দল। সম্প্রতি হাতিয়াসহ জেলার একাধিক স্থানে কোন্দলের রক্তাক্ত অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছেন নোয়াখালীর মানুষ। শুধু হাতিয়াতেই দলীয় কোন্দলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত তিনজন নেতাকর্মী।
২০১৪ সালের ১৫ই নভেম্বর জেলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কোন্দল চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সাধারণ সম্পাদক পদে একরামুল হক চৌধুরী এমপি এবং মামুনুর রশিদ কিরন এমপির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করেই মূলত বিরোধের শুরু। দীর্ঘ নাটকীয়তার পর সম্প্রতি জেলা কমিটি কেন্দ্রের অনুমোদন লাভ করে। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উচ্ছ্বাস। বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, এ জেলায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে কিছুটা ক্ষোভ রয়েছে তাদের মধ্যে। বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে একাধিক হাইব্রিড নেতা স্থান পেয়েছে। একাধিক নেতা বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটির দুই বছর পার হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে এখন পর্যন্ত কার্যনির্বাহী কমিটির একটি সভাও অফিসিয়ালি ডাকা হয়নি। বর্ধিত সভা ডেকে দলের  কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বেগমগঞ্জ, সেনবাগ ও হাতিয়ার সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের চলছে টাগ অব ওয়ার। দলীয় কোন্দলের কারণে হাতিয়া উপজেলায় প্রতিনিয়িত হানাহানি-খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। হাতিয়ায় মোহাম্মদ আলী গ্রুপ এবং অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত রক্তপাত ঘটছে। বিশেষ করে গত ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পায় অধ্যাপক ওয়ালী উল্যাহ পন্থিরা। এতে উভয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। হাতিয়ায় সাম্প্রতিক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা হয় গত ৩০শে মার্চ। হাতিয়ার আফাজিয়া বাজারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালের জন্য স্থানীয়রা ডিলার আবুল কালামের গুদাম ঘেরাও করে। এ ঘটনার জেরে গোলাগুলিতে আহত হন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আশরাফ উদ্দিন। হাতিয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর জেরে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।  হামলা চালানো হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি সদস্য মনির উদ্দিনের বাড়িতে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান নুরুল আলম (৩০)। নুরুল আলম চরকিং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নূর হোসেনের ছেলে। তিনি যুবলীগের কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। পরে হানাহানিতে আরেক আওয়ামী লীগ কর্মীও নিহত হন।
বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ কিরন এমপি জেলার রাজনীতিতে প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্যদিকে, বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আক্তার হোসেন ফয়সল। কেন্দ্র থেকে বেগমগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের কমিটি ঘোষণা করা হলে জেলা থেকে পাল্টা একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। একইভাবে জেলা থেকে বেগমগঞ্জ উপজেলা, পৌরসভা ও কলেজ ছাত্রলীগের পকেট কমিটি ঘোষণা করা হলে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কেন্দ্র থেকে সেই কমিটি স্থগিত করা হয়। সেনবাগ উপজেলায় এমপি মোরশেদ আলম গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে মেয়র টিপু গ্রুপের। এর সঙ্গে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক গ্রুপ। চাটখিল-সোনাইমুড়ী আসনে মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সংসদ সদস্য এএইচএম ইব্রাহিমকে কেন্দ্র করে দুই ধারায় বিভক্ত নেতাকর্মীরা। এদিকে দীর্ঘ কয়েক বছর এ জেলায় যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের সম্মেলন না হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়েছেন নেতাকর্মীরা। যুবলীগের একাধিক নেতাকর্মী বলেন, জেলা যুবলীগের সম্মেলন হয়েছে দীর্ঘ এক যুগ আগে। সেই সময় জেলা যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। সেই আহ্বায়ক কমিটিতে জোড়াতালি দিয়েই চলছে জেলা যুবলীগ। একই অবস্থা বিরাজ করেছে জেলার বিভিন্ন উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন যুবলীগেও। জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছে ২০১০ সালে। সম্মেলনে অনুমোদিত কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। অছাত্র, বিবাহিত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে এ জেলার ছাত্রলীগ। ২০১৪ সাল থেকে কয়েক দফা জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হলেও অদৃশ্য কারণে সম্মেলন হয়নি। ফলে ত্যাগী ছাত্রলীগ নেতারা ছাত্র রাজনীতির বয়স হারিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনও। দীর্ঘদিন ঝুলে আছে এসব সংগঠনের সম্মেলন। মেয়াদ উত্তীর্ণ উপজেলা আওয়ামী লীগ, জেলা যুবলীগ, জেলা ছাত্রলীগ, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সকল অঙ্গসংগঠনে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে সম্মেলন দিয়ে নতুন কমিটি দেয়ার দাবি জানান তৃণমূল নেতাকর্মীরা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুল আনম চৌধুরী সেলিম বলেন, বর্তমানে নোয়াখালী জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও অঙ্গসংগঠন অত্যন্ত সুসংগঠিত। তিনি আরো বলেন, সরকারের উন্নয়নে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আওয়ামী লীগের প্রতি আজ আস্থাশীল। সাংগঠনিক বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, অচিরেই মেয়াদ উত্তীর্ণ উপজেলা আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের কমিটিগুলো গঠন করা হবে।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।