29/04/2017
॥ বিশেষ প্রতিনিধি ॥
ঘুষের পরিমান সাড়ে চার লাখ টাকা। সঙ্গে বাগদা চিংড়ী, কৈ, ভেটকি মাছ, আঙ্গুর, আপেল, কলা ও মিষ্টি ছিল বোনাস। এরপর বাছাই পরীক্ষায় প্রথম হয়েও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিয়ন পদে চাকরি হয়নি সদর উপজেলার ব্যাংদহা গ্রামের নিমাই চন্দ্র ঢালীর ছেলে রাজ কুমারের। কারণ, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ঘুষের পরিমান ছিল ৬ লাখ টাকা। বাছ্ইা পরীক্ষায় রাজ কুমার মেধাতালিকায় প্রথম হয়েও চাকুরি হল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মেধা তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা অসীমের।
এরপরে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ছেলের চাকরি না হওয়ায় অসহায় নিমাই ঢালী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত। এতে প্যারালাইজড (বামপাশ) হয়ে বর্তমানে পঙ্গু জীবন-যাপন করছেন। ফলে তার রাইচমিলের চাকরিটাও চলে যাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
নিমাই ঢালী বলেন, ‘ আমি স্টোকে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর আমার ছেলেরা আমাকে ভ্যানে করে নিয়ে যান এমপি রবির বাড়িতে। আমার স্টোক হওয়ার কথা শুনে দু’তলা থেকে একটি ব্যাগে দঁড়ি বেধে ১ লাখ টাকা নীচে ফেলে দেন এমপি রবি সাহেব। আর এসময় এমপি বলেন, তুমি যাও , তোমার জন্য একটি পঙ্গু ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবো, যাতে সারাজীবন তুমি পঙ্গুভাতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারো’।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৯৬নং ব্যাংদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগে এভাবেই সাতক্ষীরা সদর-২ আসনের সংসদ মীর মোস্তাক আহম্মেদ রবিসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুললেন সদর উপজেলার ব্যাংদহা গ্রামের মৃত রাধাপদ ঢালীর ছেলে নিমাই চন্দ্র ঢালী।
শনিবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে সাংবাদিকদের সামনে অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে নিমাই ঢালী বলেন, তিনি রাইচ মিলের কর্মচারি ছিলেন। সারা জীবনের অর্জিত অর্থ এবং বাড়িতে যা যা ছিল সবই বিক্রি করে ঘুষ দিয়েও তিনি ছেলের চাকরিটা করাতে পারেননি। সেই শোকে তিনি নিজেই প্যারালাইজড হয়ে বর্তমানে পঙ্গু জীবন-যাপন করছেন। সাংবাদিকদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আপনারা একটু আমাকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। আমাদের মত মানুষের জন্য বসবাস এদেশ যেন হারাম হয়ে গেছে।
নিমাই চন্দ্র ঢালী বলেন, ২০১৪ সালে তার ছেলে রাজকুমার ঢালী সদর উপজেলার ব্যাংদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী পদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে। চাকরির আশায় তিনি নিয়োগ পরীক্ষার আগে ফিংড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খায়ের সরদারকে ২০ হাজার টাকা দেন। পরে খায়ের সরদারের কথামত ব্যাংদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি আশরাফুজ্জামান ও সহ-সভাপতি দেবাশীষ বিশ^াসকে ২ লাখ টাকা দেন। পরে খায়ের সরদারই তাকে ফোন করে জানান, ৫০ হাজার টাকা সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবিকে দিতে হবে। সে কথা মোতাবেক, গাছ বিক্রি করে তিনি ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে সাতক্ষীরা শহরে আসেন। শহরের অশোক ঘোষের ভিসা অফিসে বসে তিনি সংসদ সদস্যকে দেওয়ার জন্য দৈনিক আজকের সাতক্ষীরা পত্রিকার সম্পাদক মহসীন হোসেন বাবলুর কাছে ৪০ হাজার টাকা প্রদান করেন। টাকাটি গুনে মহসীন হোসেন বাবলু পকেটে রাখেন।
নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পাশাপাশি এতগুলো টাকা দিয়েও ছেলের চাকরি না হওয়ায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ছেলের চাকরির আশায় এদ্বার থেকে ওদ্বারে হাটতে থাকেন নিমাই চন্দ্র ঢালী। পরবর্তীতে তার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র আরো টাকা হাতানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ফাঁদ পাতে। সংসদ সদস্যকে ম্যানেজ করার জন্য সাংবাদিক মহসিন হোসেন বাবলুকে আরো ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। তাতেও চাকরি হয়নি। বাড়তে থাকে ঘুষের অংক। দহকুলার যুবলীগের পাতি নেতা শফিও বাদ যাননি ঘুষের টাকা নিতে। তাকেও দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা। এরপর তিনি সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবির মুখোমুখি হন। চাকরি দেওয়ার আশ^াসে সাতক্ষীরা রেড ক্রিসেন্ট অফিসে বসে সংসদ সদস্য নিজেই ৫০ হাজার টাকা গুনে নেন।
নিমাই চন্দ্র ঢালী বলেন, রেড ক্রিসেন্ট অফিসে বসে সংসদ সদস্য নিজে টাকা নেওয়ার পরে তিনি চাকরির বিষয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম ! নিয়োগপত্রের পরিবর্তে তার হাতে জোটে বাছাই কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ফলাফলের কাগজপত্র।
এতে কিছুটা ক্ষুব্ধ হলে সাংসদ তাকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেন, চাকরি পেতে তাকে আরো খরচ করতে হবে। পরবর্তীতে ছেলের চাকরি না হওয়ায় তার হতাশা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে চাকরি নিশ্চিত করার আশ^াস দিয়ে সংসদ সদস্যের পিএস মকছুমুল হাকিম ২০ হাজার টাকা, সংসদ সদস্যের ছোট ভাই ময়নুল ২০ হাজার টাকা এবং আওয়ামী রীগ নেতা খায়ের সরদারের ছেলে লাল্টু ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।
নিমাই ঢালী আক্ষেপ করে বলেন, শুধু টাকাই নয়, প্রতারকরা চাকরি দেওয়ার আশ^াসে বিভিন্ন সময়ে বাগদা চিংড়ি, কৈ মাছ, ভেটকি মাছ, আপেল, কলাসহ বিভিন্ন ফল-ফলাদি নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। সাড়ে চার লাখ টাকা ও এতকিছু দেওয়ার পরেও তার ছেলের চাকরি হয়নি। চাকরি পেয়েছে নিয়োগ পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকারী অসিম কুমার দাশ। ডাবলু , ডাবলূর ছেলে ও সংসদ সদস্য রবির ছেলে মীর তানজির আহমেদ ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অসিমকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছে।
অঝরে কাঁদতে কাঁদতে নিমাই ঢালি বলেন, ছেলের চাকরি না হওয়ায় তিনি খায়ের সরদারের বাড়িতে যান টাকা ফেরত চাইতে। তবে টাকা ফেরত পাওয়ার পরিবর্তে তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত হন।
এরপরে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অসহায় নিমাই ঢালী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এতে প্যারালাইজড হয়ে বর্তমানে পঙ্গু জীবন-যাপন করছেন। ফলে তার রাইচমিলের চাকরিটাও চলে যাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন তিনি।
নিমাই ঢালী বলেন, ‘ আমি স্টোকে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর আমার ছেলেরা আমাকে ভ্যানে করে নিয়ে যান এমপি রবির বাড়িতে। আমার স্টোক হওয়ার কথা শুনে দু’তলা থেকে একটি ব্যাগে দঁড়ি বেধে ১ লাখ টাকা নীচে ফেলে দেন। আর এমপি বলেন, তুমি যাও , তোমার জন্য একটি পঙ্গু ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেবো, যাতে সারাজীবন তুমি পঙ্গুভাতা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারো’।
এছাড়া ব্যাংদহা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহ-সভাপতি দেবাশীষ বিশ^াস তাকে ১লাখ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন। আর উপজেলা শিক্ষা অফিসার লাবন্য সরকার তাকে ফেরত দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা আর ফেরত পায়নি নিমাই ঢালী ।
এখন তুমি কী-চাও জানতে চেলে নিমাই ঢালী বলেন, আমার মতো আর কোন ছেলের পিতাকে যেনো পঙ্গুত্ববরণ করতে না হয়। আমি ওই এমপি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কঠোর শাস্তি চাই। তাদের অবস্থা যেনো এমনই হয়। আমি এদেশে আর বসবাস করতে চাইনে। আমাকে তোমরা ভারতে পাঠিয়ে দেও। আমাদের মতো মানুষ এদেশে বসবাস করতে পারবে না।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল খায়ের সরদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল। কিছু টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। চাকরিটা না হওয়া দুঃখজনক।
সংসদ সদস্যের পিএস মকছুমুল হাকিম নিতাই ঢালীর নিকট থেকে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় এ ব্যাপারে তার সাথে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
##