ক্রাইমবার্তা রিপোট: দেশে প্রতি মাসে প্রায় ৭৮ জন শ্রমিক পেশাগত দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। আর আহত হচ্ছে ১৪৩ জনের বেশি শ্রমিক। শ্রমজীবী মানুষদের কর্মপরিবেশ ও অধিকার নিয়ে এমন একটি বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি) ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এই ৬৩ মাসের উপাত্ত দিয়ে এমনটাই জানিয়েছে। এতে বুঝা যায়, সরকার ও শিল্প মালিকরা শ্রমিক স্বার্থের কথা যেভাবে বলে থাকে, বাস্তব চিত্র তার চেয়ে খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
ওশি’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে পেশাগত দুর্ঘটনায় পতিত হয় ৮ হাজার ৯৫৩ জন। এর মধ্যে নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৬১৬ জন। হতভাগ্য ও আহত শ্রমিকের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৭৩ জন। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে পেশাগত দুর্ঘটনায় ২৯৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ১০১ জন। নিহতদের মধ্যে ৬৮ জন প্রাতিষ্ঠানিক এবং ২২৬ জন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ছিলেন। আহতদের ৪৫ জন প্রাতিষ্ঠানিক এবং ৫৬ জন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করতেন।
শ্রমিক শ্রেণির এমন দুরবস্থার মধ্যেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ সোমবার মহান মে দিবস পালন করা হচ্ছে। এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবেও সমধিক পরিচিত। এবার দিবসটির ১৩১তম বার্ষিকী পালন হচ্ছে। এ দিনটি মাঠে-ঘাটে, কলকারখানায় খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ে রক্তঝরা সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির দিন। শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথের দিন আজ। এ বছর মে দিবসের প্রতিপাদ্য- “শ্রমিক-মালিক গড়ব দেশ; এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।” দিনটি পালন উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ভবন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দ্বীপ ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড দ্বারা সজ্জিত করা হবে।
দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকরা। এদিন শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন। শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভে। এক লাখ পঁচাশি হাজার নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে আরও অসংখ্য বিক্ষুব্ধ শ্রমিক লাল ঝান্ডা হাতে সমবেত হন সেখানে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ১০ শ্রমিক প্রাণ হারান। অন্যদিকে হে মার্কেটের ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
পরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করে। এ দেশে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯৩৮ সালে। তখন বৃটিশ শাসনামল। তারপর পাকিস্তান আমলেও মে দিবস যথাযথ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের শাসন থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে মে দিবস পালিত হয়। ঐ বছর সদ্য স্বাধীন দেশে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়।
দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মকবুল আহমাদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তারা শ্রমজীবী মানুষসহ দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও অনুরূপ বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
মে দিবস উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব তফসিলি ব্যাংক ও কলকারখানা বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও বেতারগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করবে।
এদিকে পেশাগত কারণে ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় পতিত শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার কেউ আছে বলে মনে করে না সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, নিহত শ্রমিকদের পরিবারের খোঁজ-খবর কেউ নেয় না। আহত শ্রমিকদের যথাযথ চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের ব্যাপারেও সরকার কিংবা মালিক পক্ষের নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। চার বছরেও শিল্প প্রতিষ্ঠান বিপর্যয়ের বিশ্ব জোড়া তোলপাড় করা সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বহু মানুষের হতাহতের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার গবেষণাভিত্তিক একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি তুলে ধরে ‘অ্যাকশন এইড’ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, শত শত আহত শ্রমিক আজো পর্যন্ত বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছে। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ন্যূনতম বেতন ১৫ হাজার টাকা নির্ধারন ও রেশন কার্ড চালুর দাবি জানিয়েছেন।
শ্রমজীবীদের সমস্যার কথা স্বীকার করে প্রতিমন্ত্রী মো. মজিবুল হক চুন্নু বলেন, ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে শ্রম আইন সংশোধন করা হলেও সচেতনতার অভাবে এর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। শিশুশ্রম বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন থাকা স্বত্ত্বেও গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৮৩ লাখ ইনস্পেকশন ইউনিট পরিদর্শন করতে ২০ হাজার পরিদর্শক লাগবে যা সময় সাপেক্ষ। এ অবস্থায় সচেতনতার জরুরি। তিনি বলেন, রানা প্লাজা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পরিদর্শন কর্মসূচীকে শক্তিশালী করা হয়েছে এবং পরিদর্শকের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যান্য দেশের তুলনা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকার যথাযথভাবে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
কর্মসূচি : প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল সাড়ে ৭ টায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। র্যালিটি দৈনিক বাংলার মোড় শ্রম ভবনের সামনে থেকে শুরু হয়ে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেইট হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হবে। বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিতব্য আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি থাকার কথা রয়েছে। এছাড়া মে দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে আগামী ১১ মে শ্রমিকদের মেধাবী সন্তাানদের মধ্যে আর্থিক সহায়তা দেবেন।
প্রশাসন বরাবর কয়েক দফা আবেদন করেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি না পাওয়ায় রাজধানীতে র্যালী করার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। সকাল ১০টায় নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালীটি শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এর আগে মে শ্রমিক দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল শ্রমিক দল।
এছাড়া জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় শ্রমিক জোট, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টি, সিপিবি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, জাসদ, গণফোরামসহ পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, লাল পতাকা র্যালী , আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি।