সুনামগঞ্জে গোয়াল ঘরে মানুষের বাস! ‘বাঁচতাম কেমনে এই চিন্তায় আছি’

ক্রাইমবার্তা রিপোট:  ‘বানের পানি পাহাড়ি ঢল আমরার সব ডুবাইয়া দিছে, বাঁচতাম কেমনে খাইতাম কেমনে এই চিন্তায় আছি’ আমরার বাচ্চ কাচ্ছা নিয়া খুবই বিপদে আছি, কাম কাজ নাই রোজি বন্ধ হেরলাইগা দিনে একবার খাইলে আরেকবারের আশা নাই, আইজও বাচ্চারারে কোন রহম খাওয়াইছি, উনা (অধাপেট) উফাসেই চলছে আমরার সংসার, সরকারী কোন কিছু সাহায্যের মাঝে আমর নাম নাই সাহায্য দিব কে ? নিজের বাড়ি ঘর নাই অন্যের গোয়াল ঘরের অর্ধেকটাতে আমরা থাকি, আর অর্ধেকটাতে গরু থাকে, প্লাষ্টিকের জুতা জ্বলাইয়া মশার কামড় থাইক্কা বাঁচি’ এম কষ্টের কথা বর্ণনা দিতে দিয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে হাফ ছাড়েন পাকনা হাওরের আব্দুল্লাহ পুর গ্রামের দিন মজুর জালাল মিয়ার স্ত্রী হালেমা বেগম।

 

 

গজারিয়া গ্রামের প্রবাল মিয়া ও মোহন মিয়া বলেন,যে জমি চাষ করছিলাম এবার ধান পাইনাই কি খাইয়া বাঁচমু আল্লাহ্ জানেন, সরকারী সাহায্যের তালিকায় আমরার নাম নাই লাজে শরমে লাইনে দাড়াইতে পারিনা কুবই কষ্টে আছি। হঠামারা গ্রামের কৃষক আ: রহিম বলেন, এবার সব ক্ষেত ফানির নীচে। বাঁধ ভাইংগা আমরার ফসল ডুবাইছে। যারা আমরার পেটে লাথি দিছে আল্লায় যেন হেরার বিচার করে। ফেনারবাঁক গ্রামের মধ্যবিত্ত কৃষক তোফায়েল আলম ছানা মিয়া বলেন, বহু টাকা খরচ কইরা জমি করছিলাম, কিছু ধান কাটছি কাজের লোকের বেতন দিয়া কিছুই থাকবনা। যে হাতে সারা জীবন মানুষেরে ধান বিলাইছি এবার এই হাতে সরকারী সাহায্য নেয়া লাগবো। লজ্জায় কইতেও পারছিনা সইতেও পারছিনা, আর ঋনের বোঝাতো ঘারে আছেই। শান্তিপুর গ্রামের কৃষক আশরাফুল আলম পাউবোর দুর্নিতীবাজ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের শাস্তির দাবী জানান। এভাবেই মনের নাবলা কথা গুলো বল্লেন পাকনা হাওরের ফসল হারা কৃষক শ্রমিকরা।
সরজমিন দেখা গেছে হাওর পাড়ের নিভৃত পল্লী গুলোতে ফসলহারা কৃষক পরিবার গুলোতে চরম বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানীয়, বাসস্থান ও চিকিৎসাসহ নানাবিদ সঙ্কটে ঋণগ্রস্ত ফসলহারা কৃষক, কিষাণী, জেলে ও খামারিদের মধ্যে এখন হাহাকার বিরাজ করছে। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধরমপাশা, দিরাই, শাল্লাসহ সদর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এই বিপর্যয়ের ঘূর্ণিপাকে পড়ে ফসলহার কৃষক পরিবারের আর্তনাদ ও কান্না থামছে না। সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ধান কাটার শুরু থেকেই প্রবল বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয় এবং আসাম রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের দুনীতিবাজ পাউবোর নামকায়স্তে নির্মিত ফসল রক্ষা বেড়ি বাঁধগুলো একের পর এক ভেঙে উঠতি বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ফসল ডুবার পর মাছ ও হাঁসের মড়কে তাদের চোখে অমানিশা নেমে আসে। হাওরে অজ্ঞাত এক রহস্যজনক গ্যাসের প্রভাবে বিপুল পরিমান মাছ মরে পানিতে ভাসতে থাকে। আর সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাজার হাজার হাঁসের মৃত্যু ঘটেছে। একের পর এক বিপর্যয়ে হাওরাঞ্চলের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। বোরো ফসল গোলায় ওঠার সময় যে কৃষকরা অকাতরে লোকজনের মধ্যে ধান বিলি করতেন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আজ তারাই এখন ত্রাণের আশায় প্রহর গুনছেন। হাওরের লোকজন এখন একবেলা, আধাবেলা ও অনেক পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে, তা প্রয়োজনের চেয়ে একবোরেই নগণ্য। যৎ সামান্য ত্রাণ তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। এমন পরিবারও রয়েছে এখনো কোনো ত্রাণ পায়নি। বোরো ধান চাষ করে যাদের গোলায় বারো মাস ধান থাকতো, গোয়াল ভরা গরু আর হাওরের পানিতে মাছ থাকতো, আজ গোলায় নেই ধান, গরু শুন্য গোয়াল মাছেরও দেখা দিয়েছে আকাল। অতীতে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বহুবার ফসল হারিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবারের মতো এমন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হাওরবাসী আর কখনো হননি। ফসলহারা ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা কিভাবে পরিবারের জন্য খাদ্য সংগ্রহ ও মহাজনদের ঋণ পরিশোধ করবেন সেই দুশ্চিন্তায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন। সরকারের নির্দেশনা থাকার পরেও জামালগঞ্জে বিভিন্ন এনজিও এখন পর্যন্ত কৃষকদের ঋণের কিস্তি স্থগিত বা মওকুফের কোনো ঘোষণা দেয়নি। তাই নিরুপায় হয়ে অনেকে স্ত্রীর অলঙ্কার, আসবাবপত্র এমনকি গোয়ালের গরু পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছেন। জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, ধরমপাশা, দিরাই, শাল্লার সচ্ছল মধ্য বিত্ত কৃষক পরিবারগুলো এখন অভাবের তাড়নায় পড়েছে বিপাকে। তারা না পারছে সইতে না পারছে কইতে লাইনেও দাঁড়াতে পাচ্ছেননা।
জানা যায়, এ জেলার সর্বমোট আবাদি জমির পরিমাণ ৩,৭৯,২১৬ হেক্টর। এবার আবাদ করা জমির পরিমাণ-২,৭৬,৪৪৭ হেক্টর। তার মধ্যে প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজারের অধিক হেক্টর জমিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বোরো ধান চাষ করা হয়েছিল। আর বাকি জমিতে অন্যান্য ফসল। এসব জমিতে প্রতি বছর ৯ লাখ মে:টনের অধিক ফসল উৎপন্ন হয়। যার মূল্য প্রায় ১৫ শ’ কোটি টাকার বেশি। এ জেলার ২৫ লক্ষাধিক জনসাধারণের মধ্যে প্রায় ২০ লক্ষাধিক লোক বছরের একটি মাত্র ফসলের উপর নির্ভর করে তাদের জীবন-জীবিকা। কিন্তু এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে তৈরি হাওর রক্ষা বাঁধগুলো সঠিক ভাবে সঠিক সময়ে নির্মাণ না হওয়ায় বাঁধ ভেঙ্গে হাজার হাজার কৃষকের কষ্টার্জিত সোনার ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এই ফসল ফলাতে এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেয়া ঋণ পরিশোধ কিভাবে করবে তা নিয়ে হতাশায় দিন পার করছে হাওর পাড়ের কৃষক।

 

 

Check Also

সন্ধ্যায় আবারো সড়ক অবরোধ তিতুমীর শিক্ষার্থীদের

রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করায় আবারো সড়ক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।