ক্রাইমবার্তা রিপোট:সৌদি প্রবাসী মামা রফিকুল আলমের স্ত্রী রোজিনা আক্তার মিতুর (২৭) সঙ্গে ৮ বছর ধরে পরকীয়া চলছিল ভাগনে আহমেদ শরীফ শাকিলের (৩০)।
এরই মধ্যে মিতু আরও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ায় ক্ষোভ বাড়তে থাকে শাকিলের। নিজের ফুফাতো ভাই সেনাসদস্য নজরুলের সঙ্গেও পরকীয়া চলছিল মিতুর। নজরুল ও মিতুকে এক বিছানায় দেখেই মাথায় রক্ত উঠে যায় শাকিলের।
এরপর দোকান থেকে দামি ছুরি কিনে এনে মিতুকে গলা কেটে হত্যা করে সে। এসব তথ্য শনিবার শাকিলই জানিয়েছে ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিতুকে হত্যাকারী শাকিল বর্তমানে মাদারীপুরের শিবচরে একটি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যানের চাকরি করছে। তারপর বিশেষ ব্যবস্থায় শনিবার সঙ্গে কথা হয় শাকিলের। সে জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় এক মাস ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যানের চাকরি নিয়েছে। সে নিজেও জানে, যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। গ্রেফতার হলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেও রাজি সে।
শাকিল জানায়, তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের লাউতলি গ্রামে। বাবা আবদুল মান্নান এক সময় রড-সিমেন্টের ব্যবসা করতেন। বৃদ্ধ বাবা এখন অসুস্থ। ২০০৯ সালের জুনে সৌদি প্রবাসী মামা রফিকুল আলমের সঙ্গে মিতুর বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মামা সৌদি আরব চলে যান। এরপর অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় মামি মিতুর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে শাকিল। নেয়াখালী কলেজে ইংরেজিতে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি সে দুবাই চলে যায়। কিন্তু পরকীয়ার টানে ২০১৩ সালের মে মাসে দেশে ফিরে আসে।
শাকিল বলে, ‘একদিন বড় মামা শফিকুল আলম আমাদের দু’জনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন। মামা পরপর তিনবার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মেম্বার হন। ওই সময় তিনি ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় তখন বিষয়টি সবাইকে জানানো হয়নি। এমনকি ১৪ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকা মিতুর স্বামী রফিকুল আলমকেও জানানো হয়নি। তখন আমাদের দু’জনকে কোরআন শরিফ হাতে নিয়ে শপথ করানো হয় যে, আমরা আর কখনও এ ধরনের কাজ করব না। এমনকি কেউ কারও সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা, কথাও বলব না। এর কিছুদিন পর বড় মামার ছেলে ইমনের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ে মিতু। এরপর দুই পরিবারের মধ্যে বৈঠক হয়। একপর্যায়ে সৌদি প্রবাসী মামার পরামর্শে ২০১৫ সালের আগস্টে মামি তার দুই সন্তান মিনহা আলম পহেলা (৭) ও তাহবা আলম উম্মিকে (৪) নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। রাজধানীর বিমানবন্দর থানার কাউলার একটি বাসায় মিতু তার ছোট ভাই রহিম ও দুই মেয়েকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন। এ সময় মিতু তার মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেন।’ তবে শফিকুল আলম শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘মিতু হত্যার ঘটনা ঢাকায় ঘটছে, সেখানে কি হয়েছে তা আমি জানি না।’ মিতু-শাকিলের পরকীয়া কিংবা তার ছেলে ইমনের সঙ্গে মিতুর আপত্তিকর সম্পর্ক নিয়ে শফিকুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শাকিল বলে, ‘মিতু তার নম্বর পরিবর্তনের পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মিতু বাসা বদলিয়ে কাফরুলের ইব্রাহিমপুরের হাবিবুল্লাহ রোডের বাসায় উঠে। একদিন মিতুর ভাই রহিম আমাদের একসঙ্গে দেখে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়। মিতুকেও মারধর করে। এ ঘটনায় মিতু ১৬ অক্টোবর তার ভাইকে বাসা থেকে বের করে দেয়। এরই মধ্যে মিতুর বাসায় তার ফুফাতো ভাই সেনাসদস্য নজরুলের আগমন ঘটে। নজরুল একবার আমাকে মিতুর সঙ্গে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে ফেলে। এরপর থেকে নজরুল প্রতি বৃহস্পতিবার মিতুর বাসায় এসে শুক্রবার বের হয়ে যেত। এ নিয়ে মিতুর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে মনোমালিন্য হলেও পরে ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু সম্প্রতি মিতু আমার ফোন ধরত না। বাসায় প্রবেশ করতেও দিত না। এ নিয়ে ১৭ এপ্রিল সারা রাত আমার ঘুম হয়নি। পরদিন ১৮ এপ্রিল ভোরে মিতুর নিচ তলার বাসার দেয়াল টপকে জানালা দিয়ে দেখি, একটি রুমে নজরুলের সঙ্গে শুয়ে আছে মিতু। অন্য রুমে তার দুই সন্তান ঘুমাচ্ছিল। এরপর আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। সকাল ৭টার দিকে নজরুল ওই বাসা থেকে বের হয়। এরপর আমি ওই বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করলে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এতে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরে কচুক্ষেতের একটি দোকান থেকে ২৭৬ টাকা দিয়ে একটি ছুরি কিনে আনি। বেলা ১১টার দিকে বাসায় নক করলে মিতুর মেয়ে পহেলা দরজা খুলে দেয়। এ সময় মিতু গোসল করছিল।’
শাকিল আরও বলে, ‘আমি বাথরুমে গিয়ে মিতুর কাছে জানতে চাই নজরুল কেন এ বাসায় এসেছিল। এর জবাবে মিতু জানায়, আমি যার সঙ্গে ইচ্ছা তার সঙ্গে রাত কাটাব। এতে তোর সমস্যা কী? তোকে তো আমি এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছি। এখানে এসেছিস কেন? এ সময় মিতুর দুই মেয়েকে একটি রুমে রেখে আমি এক হাতে ছুরি ধরে অন্য হাতে দরজা আটকানোর চেষ্টা করি। তখন মিতু আমার হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে আমাকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মিতু বাথরুমের কমোডে পড়ে গেলে তার কাছ থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে প্রথমে তার হাতের রগ কাটি, পরে গলায় ছুরি চালাই। বুকে ও পেটেও আঘাত করি। আমার দুই হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানেও আঘাত পাই। একপর্যায়ে মিতু নিস্তেজ হয়ে পড়লে আমি পেছনের গেট দিয়ে দেয়াল টপকে ছুরি ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।’
শাকিল জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর বাসা থেকে বের হয়ে সে প্রথমে রিকশা ও পরে সিএনজিতে মিরপুরের আলরাজী হাসপাতালে যায়। এ সময় তার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এদিকে তার হাতের অবস্থা দেখে আলরাজী কর্তৃপক্ষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু সে আলরাজী থেকে হাতে ব্যান্ডেজ করে কেরানীগঞ্জে তার ভাই শাওনের বাসায় যায়। সেখান থেকে দু’জন নৌকায় রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে যায়। মিডফোর্ট হাসপাতালে তার দুই হাতে ৩২টি সেলাই দেয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসা শেষে শাওনের প্রতিষ্ঠানের সেলসম্যান বিল্লালের বাসায় (কেরানীগঞ্জ, কদমতলী, চুনকুটিয়া) উঠে। ৩ মে পর্যন্ত ওই বাসাতেই ছিল শাকিল। পরে বিল্লালের মাধ্যমে মাদারীপুরের শিবচরে বিশ্বাস গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে ৫ মে সেলসম্যান হিসেবে কাজ নেয় শাকিল। পাশাপাশি শিবচর উপজেলা পরিষদের পাশে টিন শেডের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছে শাকিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এতদিন মামলাটি কাফরুল থানা পুলিশ তদন্ত করলেও বৃহস্পতিবার তা ডিবির কাছে আসে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন যুগান্তরকে বলেন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) শাহাদাত হোসেন সুমার নেতৃত্বাধীন একটি টিম বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই আসামি ধরা পড়বে।