প্রকাশ : ১৪ মে ২০১৭,
রাজধানীর বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সাফাত আহমেদ রিমান্ডের প্রথম দিনেই গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রায় এক ডজন বান্ধবীর নাম ফাঁস করেছেন।
এসব বান্ধবীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের কথাও খোলামেলা স্বীকার করেছেন তিনি। বান্ধবীদের মধ্যে উঠতি কয়েকজন মডেলও রয়েছেন।
সাফাত গোয়েন্দাদের বলেছেন, প্রতিদিন তার হাতখরচ ছিল ২ লাখ টাকা। আর এ টাকার জোগান দিতেন তার বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ। তিনি বলেছেন, প্রতি রাতেই তারা এ ধরনের পার্টি করতেন। পাঁচ তারকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে আয়োজিত এসব পার্টিতে বন্ধু-বান্ধবীরা হাজির থাকতেন। এসব পার্টিতে বান্ধবীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের বর্ণনা করে সাফাত গোয়েন্দাদের বলেছেন, সবকিছুই সমঝোতার ভিত্তিতে হয়েছে।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করে সাফাত দাবি করেছেন, ‘এটিও জোর করে হয়নি।’ এর সপক্ষে গ্রেফতারকৃত সাফাত আহমেদ কিছু প্রমাণও দেখিয়েছেন গোয়েন্দাদের। এর মধ্যে সাফাত আহমেদ অভিযোগকারী দুই তরুণীর মধ্যে একজনের সঙ্গে ঘটনার রাতে তোলা ঘনিষ্ঠ কিছু ছবিও (সেলফি) দেখান গোয়েন্দাদের।
এদিকে শনিবার সকালে ঘটনাস্থল বনানীর দি রেইনট্রি হোটেল পরিদর্শন করেছে ওই ঘটনায় গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবস্থানকালে তদন্ত কমিটির সদস্যরা হোটেলটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন।
পরে তদন্ত কমিটির প্রধান নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় হোটেলটিতে মানবাধিকার লংঘন হয়েছে।’ প্রায় একই সময়ে বনানীর ‘কে’ ব্লকে ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বরে রেইনট্রি নামের হোটেলটিতে তল্লাশি চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি দল। তবে তল্লাশি শেষে হোটেলটিতে অ্যালকোহলজাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেন নারকোটিকস গুলশান জোনের পরিদর্শক ওয়াবদুল কবির।
অন্যদিকে হোটেলটির পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ‘রহস্যজনক’ কারণে ধর্ষকদের পক্ষ নিয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। শনিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পৃথক অনুসন্ধান শেষ হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করেন। এ সময় হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার ও ইন্টার্নাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ ফারজান আরা রিমি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার রাতে সাফাত আহমেদ ফ্রন্ট ডেস্কে অস্ত্র জমা দিয়েই তার বন্ধুদের নিয়ে হোটেলটিতে প্রবেশ করেছিলেন। এর ফলে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী ‘অস্ত্রের মুখে ধর্ষণের যে অভিযোগ তুলেছেন, তা মিথ্যা ও অবান্তর’ বলে দাবি করেন ফারজান আরা রিমি। প্রেস ব্রিফিংকালে হোটেলটির জেনারেল ম্যানেজার ফ্র্যাংক ফরগেটও উপস্থিত ছিলেন।
চাঞ্চল্যকর এ ধর্ষণ মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সাফাত আহমেদের দেয়া তথ্য তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন। তবে ওই দুই তরুণীর সঙ্গে তাদের যৌন সম্পর্কের বিষয়টি আপসে হয়েছে- সাফাতের এমন দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পুলিশ ওই ধর্ষণ মামলাটি তদন্ত করছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এসব তথ্যপ্রমাণ আমলে নেয়া হচ্ছে না। কারণ আপসে হলে মামলা হওয়ার সুযোগ নেই।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, রাজধানীর বনানীতে দি রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন এমপিপুত্র মাহিন হারুন। ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য বিএইচ হারুনের ছেলে মাহিন হারুনকেও আইনের আওতায় আনা হতে পারে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ঘটনার দিন তিনি (মাহিন) ফোনে সাফাত আহমেদের নামে হোটেলের দুটি কক্ষ ভাড়া করেছিলেন। এছাড়া গভীর রাতে মাহিন হারুন একবার সাফাত ও তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে হোটেলটিতে যান। এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসবাদে গ্রেফতারকৃত সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ দাবি করেছে, ‘ঘটনার রাতে ধর্ষণের মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেই রাতে যা কিছু ঘটেছিল তার সব সবকিছুই হয়েছিল আপসে।’
এদিকে শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রেইনট্রি হোটেলের অপারেশন এক্সিকিউটিভ ফারজান আরা রিমি সাংবাদিকদের বলেন, ২৮ মার্চ ঘটনাটি ঘটছে এমন দাবি করা হলেও হোটেলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ৯ এপ্রিল উদ্বোধন হয়। তিনি বলেন, ঘটনার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে সেদিন তল্লাশির জন্য হোটেলটির আর্চওয়ে (তল্লাশির বিশেষ যন্ত্র) কানেকটেড না থাকায় অভিযুক্তরা মদ নিয়ে হোটেলে ঢুকেছিল কিনা, সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে রিমি বলেন, হোটেলটির প্রত্যেকটি কক্ষ সাউন্ডপ্র“ফ। বাইরে থেকে কোনো শব্দ শোনা যায় না। ঘটনার রাতে কোনো শোরগোল হয়ে থাকলেও তা হোটেল কর্তৃপক্ষ শোনেনি বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান। একই সঙ্গে তিনি বলেন, হোটেলটির সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজ সার্ভারে ২৮ দিনের বেশি থাকে না। এ কারণে এখন ওই ফুটেজ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে প্রযুক্তির সহায়তায় ওই ফুটেজ উদ্ধার করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন চাঞ্চল্যকর ওই ধর্ষণ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম। তিনি বলেন, রিমান্ডে থাকা দুই আসামি ওই রাতে অভিযোগকারী দুই তরুণীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তবে সেটি জোর করে হয়নি দাবি করে গ্রেফতারকৃত সাফাত আহমেদ এর সপক্ষে কিছু প্রমাণও দেখিয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ঘটনার রাতে রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তোলা কিছু ছবি গোয়েন্দাদের দেখিয়ে সাফাত দাবি করেছে, ‘সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল; কিন্তু কেন যে তারা অভিযোগ করেছে তা বুঝতে পারছেন না। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত বলেছে, এর আগেও তারা অসংখ্যবার এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে কখনও কেউ অভিযোগ করেনি। বিষয়টি এতদূর যাবে, এটা তাদের কল্পনায়ও ছিল না।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ বনানী-গুলশানকেন্দ্রিক অনেক ধনীর দুলালের ‘রঙিন জগতের’ তথ্য দিয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত আহমেদ জানান, তাদের ২০ থেকে ২২ জন বন্ধুর একটি গ্রুপ আছে। এ গ্রপে তাদের বন্ধুদের মধ্যে দেশের বেশ কয়েকজন শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের প্রভাবশালীদের সন্তান রয়েছে। তারা রাত হলেই একটি স্থানে জড়ো হন। প্রতিরাতেই তারা পাঁচতারকা হোটেলে বিভিন্ন পার্টি ছাড়াও রেসিং কার নিয়ে লং ড্রাইভে যেতেন। মাঝেমধ্যে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ আশপাশের দেশে দল বেঁধে বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরতে যেতেন। প্রতিদিন তার হাত খরচের দুই লাখ টাকা তার বাবা দিতেন বলে দাবি করেন সাফাত। কখনও এর বেশি টাকার প্রয়োজন হলে ঢাকা শহরে আপন জুয়েলার্সের ৮টি শোরুমের যে কোনো একটিতে ফোন করে অতিরিক্ত টাকা আনিয়ে নিতেন। কখনও তার বাবা এ টাকা খরচের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেননি।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ মার্চ বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণী। ওই ঘটনায় গত ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ (সিরাজগঞ্জের আবদুল হালিম) ও সাদমান সাকিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তারা। বর্তমানে সাফাত আহমেদ ছয় ও সাদমান সাকিফ পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ মামলার পলাতক আসামি মোহাম্মদ হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ, ড্রাইভার বেলাল ও দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদের অবস্থান জানতে তাদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।