আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবার্তা রিপোট: সাতক্ষীরা : ইউরোপের বাজারে সাতক্ষীরার আমের কদর বাড়ছে। তাই ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে সাতক্ষীরার হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম। তৃতীয় বারের মত এবছর ও সাতক্ষীরার আম ইউরোপের বাজারে পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার রাতে রপ্তানির প্রথম চালানই পাঠানো হলো ইউরোপের দেশ ফ্রান্স ও ইতালিতে। আম পাকাতে বিষাক্ত পদার্থ কারবাইট বন্ধ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদাড়ি বাড়াতে পারলে রপ্তানিতে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবী।
ইত্যোমধ্যে সদর,কালিগঞ্জ,দেবহাটা সহ কয়েকটি স্থানে আম পাকাতে বিষাক্ত পদার্থ কারবাইট ব্যবহারের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রচুর আম নষ্ট করে দিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জানান,আমে যাতে কেউ বিষাক্ত পদার্থ কারবাইট ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত সবসময় কাজ করছে। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান,বলেন,আমচাষীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে এবছর আমের ফলন ভাল হয়েছে।
দেশে বর্তমানে আমের নাম বলতেই আগে আসে সাতক্ষীরার নাম। মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে সাতক্ষীরার উৎপাদিত আম অনেক সুস্বাদু হওয়ায় এবং অন্যসব জেলার আগে এ জেলার আম পাকায় এর কদর এবং চাহিদা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও বেড়েছে।
সাতক্ষীরায় মাটি ও জলবায়ু আম চাষের জন্য অনুকুল হওয়াতে জেলার চাষীরা আম চাষে আগ্রহী। পুরুষের পাষাপাশি মহিলারাও আম চাষে ঝুকে পড়েছে।
প্রাকৃতিক কারণে এ জেলাতে আমে আগে মুকুল আসে ও আগে পেকে যায়। যে কারণে জেলাতে এখন আম উৎসব চলছে। জেলা অলি-গলি সবখানে আম আর আম। এ ছাড়া সাতক্ষীরার আম অনেক সুস্বাদু। তাই সাতক্ষীরার আম এ বছর ইতালি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের বাজারে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আম কিনতে এখন সাতক্ষীরাতে ভীড় করছে ক্ষুদ্র ও পাইকারী ব্যবসায়ীরা। মধু মাসের প্রথম দিনেই সাতক্ষীরার হিমসাগর আম গেল ইউরোপে। আর এর মধ্য দিয়েই আম রপ্তানিতে কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টা তৃতীয়ারের মতো সাফল্যের মুখ দেখলো।
গত সোমবার রাতে রপ্তানির প্রথম চালানেই জেলার দেবহাটা উপজেলার ছয়জন ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তিনজন চাষীর বাগানের হিমসাগর আম পাঠানো হলো ইউরোপের দেশ ফ্রান্স ও ইতালিতে।
আম পেপে বাগানেই প্যাকেটজাতকরণের পর রাতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহ তা নিয়ে রওনা হয় বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।
এর আগে গুণগত মানসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া তদারকি করেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ সজল, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেনসহ অন্যান্যরা।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন জানান, প্রথম চালানে দেবহাটা উপজেলা থেকে ৩৫৯৪ কেজি ও সদর উপজেলা থেকে ৩৬৮৯.৬ কেজি হিমসাগর আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তাসিন এন্টারপ্রাইজ ও হক এন্টার প্রাইজের মাধ্যমে ইতালি ও ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছে।
সাতক্ষীরা শহরের কামালনগরের আম চাষি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত মৌসুমের পর থেকেই কৃষি বিভাগের পরামর্শে বিষমুক্ত রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি। আজ তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। প্রথমদিনেই তার বাগান থেকে প্রায় দুই মেট্টিক টন আম রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য চাষিদের তুলনায় বেশি দাম পেয়ে উচ্ছ্বসিত জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, বর্তমানে বাজারে হিমসাগর আম দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুইশো টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু আমার আম বাগান থেকেই আড়াই হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান জানান, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা থেকে তৃতীয়বারের মতো আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, তালা ও কলারোয়া উপজেলা থেকে আরও আম রপ্তানি হবে।
সাতক্ষীরা থেকে এ বছর আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৫০ মেট্টিক টন উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, এর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
১৫ মে থেকে সাতক্ষীরার হিমসাগর আম গাছ থেকে পাড়ার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এর পর থেকে একে একে অন্য জাতের আম পাড়তে হতো। সেই আমের কিছু অংশ রপ্তানি হতো ইউরোপে।
কিন্তু কালবৈশাখীতে আমচাষিদের সেই স্বপ্ন অনেকটা তছনছ করে দিয়েছে। চলতি সপ্তাতে কয়েক দফায় ঝড়ের কবলে পড়ে জেলার আমবাগানগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আমচাষিরা জানিয়েছেন, এবার আমের ফলন ছিল চমৎকার। এতদিন আবহাওয়াও ছিল অনুকূলে। তাঁদের আশা ছিল এবার আম রপ্তানি করে লাভবান হবেন। এ ছাড়া দেশীয় বাজারেও সাতক্ষীরার সুস্বাদু আম পৌঁছে দেবেন।
হতাশা ব্যক্ত করে চাষিরা বলেন, কয়েক দফায় কালবৈশাখী তাঁদের সব স্বপ্নকে তছনছ করে দিয়েছে।
সদর উপজেলার লাবসা গ্রামের আমচাষি জাহাঙ্গীর আলম জানান, ঝড়ে তাঁর সবগুলো আমবাগানের কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। একটি আমবাগানের অনেকগুলো গাছ ভেঙে পড়েছে। সেখানে অন্তত ৩০০ মণ হিমসাগর ও ল্যাংড়া জাতের কাঁচা আম পড়ে গেছে।
কৃষি বিভাগের সূত্রমতে, গত বছরে আম লন্ডনে রফতানি হয়েছিল। এবার লন্ডন ছাড়াও ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানিতে আম রফতানি হচ্ছে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আম রফতানিবিষয়ক কমিটির সমন্বয়ক কৃষিবিদ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কৃষি বিভাগ চাষিদের আগে প্রশিক্ষণ দেয়। আমের মান অক্ষুণ্ণ রাখতে যে সব পরামর্শ দেওয়া হয়, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন কৃষকরা। পোকা-মাকড় দমনে কীটনাশকের পরিবর্তে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেন কৃষকরা। ক্ষতিকারক কোনো কিছুই প্রয়োগ করা হয় না আমে। এ বছর জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উদ্যোগে জেলার ২০ জন চাষিকে আম চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোতে হিমসাগর আর ল্যাংড়া আমের চাহিদা ভালো। তবে প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টি বেশ জটিল। গতবার প্রক্রিয়াকরণের কাজটি ঢাকাতে হয়েছিল। এবার সরকারি নির্দেশে উপজেলা থেকে প্রক্রিয়াকরণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন রফতানিকারকরা।
আমচাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘কৃষি বিভাগের পরামর্শ মেনে আম চাষ করায় এবার আমে পোকা হয়নি। এবার আম বিদেশে পাঠাচ্ছি। প্রথম পর্যায়ে হিমসাগর গেলেও কিছুদিন পর থেকে যেতে শুরু করবে ল্যাংঢ়া ও আম্রপালি।
আম ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম জানান, ১৬ লাখ টাকার আমবাগান কিনেছি। সাতক্ষীরায় হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, গোবিন্দভোগ, কিষানভোগ, গোলাপখাস, শরিফখাস, রানী পছন্দ, লতা, আলফ্রেন্স বোম্বাই, রূপালি, চন্দ্রমল্লিকা, কালাপাহাড়, আম্রপালি ও কাঁচামিঠা আমের উৎপাদন বেশি।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা জেলায় আমের আবাদ হয়েছে মোট ৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে। যা গতবারের তুলনায় ৫০ হেক্টর বেশি। আম উৎ্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। যা গতবছরের তুলনায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন বেশি।
সূত্র আরো জানায়, গত বছর সাতক্ষীরা জেলা থেকে ২৩ টন হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যের বাজারে রফতানি হলেও এ বছর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২শ মেট্রিক টন। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এ বছর কৃষি বিভাগের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সুন্দর পরিষ্কার দেখে সদর উপজেলার ১৫০টি, কলারোয়া উপজেলার ১০০টি, দেবহাটায় ৪০টি ও তালা উপজেলায় ৮৭টিসহ মোট ৩৭৭টি আম বাগানের ২২০ জন মালিকের ১৪ হাজার ৪৫১টি হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম গাছ বিশেষভাবে প্রস্তত করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের জন্য। আর এসব আম গাছ বিষমুক্ত রাখতে চাষিদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব বাগান থেকে চলতি মৌসুমে ৬০০ মেট্রিক টন আম উত্পাদন করা সম্ভব হবে যা থেকে বাছাই করে ২০০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রফতানি করা যাবে।
আম চাষিদের দাবি, সরকার যদি আম পাড়া বা সংরক্ষণের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাহলে আমাদের আমে দাগ হবে না। ডিমের খাচিরমত বিশেষ কায়দায় আম বাজারজাত করা গেলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে বিদেশেও এর চাহিদা আরো বাড়বে।
এদিকে সাতক্ষীরায় ক্যামিক্যাল স্প্রে করার অভিযোগে প্রায় ৫০ মণ আম জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাতক্ষীরা পৌরসভার চালতেতলার তপন দাশের গোডাউনে অভিযান চালিয়ে এই আম জব্দ করা হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন সাতক্ষীরা জেলা কালেক্টরেটের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু তালেব।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের পেশকার জগদীশ বিশ্বাস জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালতেতলায় অভিযান চালিয়ে ক্যামিক্যাল স্প্রে করার সময় হাতেনাতে প্রায় ৫০ মণ গোবিন্দ ভোগ, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম জব্দ করা হয়। এছাড়া একই অভিযোগ কালিগঞ্জ,দেবহাটা,তালা সহ কয়েকটি স্থানে অভিজান চালানো হয়। –আবু সাইদ বিশ্বাসঃসাতক্ষীরা
Check Also
আশাশুনি সদর ইউনিয়ন জামায়াতের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আশাশুনি সদর ইউনিয়নের ৮টি ওয়ার্ডে আংশিক কমিটি গঠন করা …