চরম উত্তেজনা ও বিতর্কের মধ্যেই সেই ভাস্কর্যটি আবার স্থাপন করা হলো সুপ্রিমকোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে। শনিবার রাত আটটা থেকে ভাস্কর্যটি প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হয়। ছোট পিকআপে করে ভাস্কর্যটি রাত দশটার দিকে এনেক্স ভবনের সামনে নিয়ে আসা হয়। পরে ভার উত্তোলক যন্ত্র দিয়ে পিকআপ থেকে ভাস্কর্যটি নামানো হয়। এ সময় ভাস্কর্য প্রতিস্থাপনের কাজ তদারকি করেন এর শিল্পী মৃনাল হক নিজেই। মোট ২৭ জন শ্রমিক এই কাজে অংশ নেয়। ভাস্কর্য স্থাপন শেষে ঝালাইয়ের কাজ শুরু হয় রাত ১১টা ৪০ মিনিটে। রাতেই এর কাজ শেষ হয়। এদিকে ভাস্কর্যটি প্রতিস্থাপনের আগে রাত ৮টা থেকে সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। সুপ্রিমকোর্টের কর্মকর্তা/কর্মচারি ছাড়া ভেতরে গণমাধ্যমকর্মীসহ কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। ভাস্কর্য স্থাপনের সময়ও এর আশপাশে বিপুল পুলিশ মোতায়েন ছিল। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে সুপ্রিমকোর্টের ফটকে (বার কাউন্সিল সংলগ্ন) এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, এটা এখানে বসানোর জন্য আজ (শনিবার) সকালে আমাকে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এখানে (এনেক্স) বসানো না বসানো সমান কথা। কারণ এখানে এটিকে কে দেখবে? কাদের নির্দেশে এনেক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্য বসানো হয়েছে-এমন প্রশ্নে মৃণাল হক বলেন, সুপ্রিমকোর্ট অথরিটির নির্দেশে এখানে বসানো হয়েছে। আর যারা সরাতে বলেছিল তারাই এখানে (এনেক্স) বসাতে বলেছে। ভাস্কর্যটিকে প্রতিস্থাপন অনুভূতির বিষয়ে জানতে চাইলে মৃণাল হক বলেন, একটা মানুষ মারা গেলে তাকে কবরে দিয়ে এলে যে অনুভূতি হয়, আমারও সেই অনুভ’তি হচ্ছে। তবুও ভাস্কর্যটা নিজের পায়ে দাঁড়াবে এটাই বড় কথা। তিনি আরো বলেন, আমরা লুকিয়ে, গোপনে এটি প্রতিস্থাপন করলাম। কেন এত লুকানো, কেন এত গোপনীয়তা?
গত ডিসেম্বরে সুপ্রিমকোর্টে স্থাপন করা হয়েছিলো এটি। আর এ ভাস্কর্যটি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। এটি স্থাপনের পর থেকে হেফাজতে ইসলাম এটিকে ‘গ্রীক দেবীর মূর্তি’ আখ্যায়িত করে আন্দোলনের হুমকি দেয়। ইসলামী ঐক্যজোটও আলটিমেটাম দেয়। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন তা অপসারণের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত ভাস্কর্যটি সরানো হয়। ভাস্কর্য অপসারণের পর থেকেই গণজাগরন মঞ্চ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা শুক্রবার বিক্ষোভ করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিতর্কের কেন্দ্রে ভাস্কর্য অপসারণ
সুপ্রিম কোর্টে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর কয়েক মাস আগে একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছিলো যে, এ নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হতে পারে। এক পর্যায়ে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি দল ভাস্কর্য অপসারণে আন্দোলনে নামে। শুক্রবারকেন্দ্রিক বিক্ষোভও করেন তারা। গণভবনে এক অনুষ্ঠানে আলেমরা ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তোলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দাবির প্রতি সায় দেন। পরে এ নিয়ে তিনি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে কথাও বলেন।
এখন অবশ্য বলা হচ্ছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতিই নিয়েছেন। এটা বিস্ময়কর না যে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা এ ইস্যুতে প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত আদালতের। এবং এটি সরকারের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তিনি অবশ্য এখন বলছেন, দেশের অন্য কোনো স্থানের ভাস্কর্য অপসারণ করা হবে না। বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও বলেছেন, ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্ত প্রধান বিচারপতিই নিয়েছেন। এটা এরইমধ্যে জানা গেছে, ভাস্কর্য অপসারণের আগে এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং সিনিয়র আইনজীবীদের মত নিয়েছেন। অপসারণ করা হলেও এটি কোথায় নেয়া হবে অথবা স্থাপন করা হবে এ নিয়েও এসব মতবিনিময়ে আলোচনা হয়েছে।
ভাস্কর্য অপসারণের পর এ নিয়ে দৃশ্যত দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। প্রগতিশীল শিবির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, এটি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ ভোটের জন্য আপোষের পথ বেছে নিয়েছে বলেও দাবি তাদের। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এ নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠেছে। সেখানেও দুই ভাগ। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে পুলিশ জলকামান ব্যবহার করেছে। প্রতিবাদকারীদের আসামি করে থানায় মামলাও হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম এ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। কিন্তু, হেফাজতে ইসলাম ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, ভাস্কর্যটি এনেক্স ভবনের সামনে স্থাপন করা হলেও তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাবে।
ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনে কাজ চলছে: মৃণাল হক
অনলাইন ডেস্ক : সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটক থেকে সরিয়ে নেয়া গ্রিক দেবী থেমিসের মূতিটি অ্যানেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। এর স্থপতি মৃনাল হক শনিবার রাতে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, রাত ১২টার দিকে এটি কংক্রিটের ভিত্তির ওপর বসানো সম্পন্ন হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তিনি মূর্তি পুনঃস্থাপনের কাজ তদারকি করেন বলে জানান।
এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণ করা হয়। প্রতিবাদে শুক্রবার বাম ছাত্র সংগঠনসহ কয়েকটি সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট মাজারের সামনে অবস্থান নেয়। একই দিন কয়েকটি ইসলামী দলও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করে।
এ দিকে মূর্তি পুন:স্থাপনের প্রতিবাদে গত রাত ১ টা থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন। ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন-এর কেন্দ্রীয় তথ্য-গবেষণা ও প্রচার সম্পাদক মুহাম্মাদ ইলিয়াস হাসান রাত পৌনে চার টায় জানান, তারা মূতি পুন:স্থাপনের প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। তবে রাত সাড়ে চার টার দিকে পুলিশ প্রেসক্লাবের সামনের অবস্থান কর্মসূচি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় কয়েকজনকে আটক করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
ঢাকা: সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন ভাস্কর্যের নির্মাতা মৃণাল হক।
শনিবার রাতে এ কথা জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে অপসারণ করা হয় সুপ্রিমকোর্টের সামনের গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এর অপসারণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় শুক্রবার ভোরে।
ওই রাতে ভাস্কর্যটি সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন ভাস্কর্যটির স্থপতি মৃনাল হক।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে ওই ভাস্কর্যটির ভাস্কর মৃণাল হক সুপ্রিমকোর্টের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সাংবাদিকদের বলেন, কর্তৃপক্ষ তাকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে বলেছে। আগামীতে এনএক্স ভবনের সামনে ভাস্কর্যটি বসানো হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
কেন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের ও জনগণের শান্তির জন্য অনেক সময় অনেক কিছু করতে হয়। এ ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়াও তেমনি একটি কাজ।
তিনি বলেন, অনেকে এটিকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য বলে মনে করেছেন। কিন্তু বাস্তবে এটি শাড়ি-ব্লাউজ পরা একটি বাঙালি নারীর ভাস্কর্য।
মৃণাল হকের শিল্পকর্মটি মাটির নিচ থেকে তুলে আনা হবে। মতিঝিলের পূর্বাণী হোটেলের সামনে বলাকা ভাস্কর্য, বিমানবন্দরের সামনে লালন ভাস্কর্য, শেরাটনের সামনে ঘোড়ারগাড়ি নিজ খরচে তৈরি করেছেন তিনি। এর মধ্যে লালন ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মৃণাল হক বলেন, আমেরিকায় আমি রাজকীয়ভাবে ছিলাম। নিউইয়র্ক সিটির বিউটিফিকেশনের দায়িত্বে ছিলাম। আমি সব ফেলে দিয়ে নিজের দেশে এসেছি। আমরা খালি দেশকে মুখে ভালোবাসি। আর আমি প্র্যাক্টিক্যালি ভালোবাসি। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে গেছে, তবু আমি দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাই।
এর আগে গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন এক দল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন। এ মূর্তি অপসারনের বিষয়টি নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রীর কথা হয়। রোজা শুরুর আগে এ ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছিল ইসলামী সংগঠনগুলো।
ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানায়।