যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলোনা, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”

মাহে রমজানের সওগাত-মানবতার জন্য অফুরন্ত রহমাত,

রমজান মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য

রমজান মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য
রমজানের রয়েছে ঐতিহাসিক তিন প্রেক্ষাপট, এবং তাতে আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা। প্রেক্ষাপট গুলো এই-
১. রমজান কুরআন নাযিলের মাস ঃ মহাগ্রন্থ আল কুরআন এ মাসেই নাযিল হয়েছে। আল কুরআনের কারণেই মূলত রমজান মাস তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে উঠেছে। কুরআন নাযিল মানবতার প্রতি মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় করুণা। এ করুণার ফলে উম্মাতে মুহাম্মাদী সবচেয়ে মর্যাদাবান জাতিতে অভিহিত । কুরআনের বদৌলতে মুসলমানরা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হয়েছিলেন।
আজ মুসলমানরা কুরআন থেকে দূরে বহু দূরে। তাই তো আমরা পৃথিবীতে অপমানিত নিপীড়িত। আজ আমাদের অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেছে। অথচ মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে আমরা মুসলমানরা আমাদের জীবনের মূলমন্ত্রে পরিণত করলে আমাদের হৃত গৌরব আবারো ফিরে আসবে। তাই কুরআন নযিলের এ পবিত্র রমজান মাসে আমরা বেশী করে কুরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের আলোকে আমরা আমাদের নিজেদের জীবন গড়ে তুলব। আর সেটাই হবে পবিত্র মাহে রমজানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

উল্লেখ্য যে সকল আসমানি গ্রন্থ রমজানে অবতীর্ণ হয়েছে ঃ
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণের প্রতি যত কিতাব নাযিল করেছেন, তা সবই রমজান মাসেরই বিভিন্ন তারিখে নাযিল হয়েছে। হযরত কাতাদা রহ. এর বর্ণিত রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হযরত ইব্রাহীমের আ. সহীফা সমূহ রমজানের প্রথম তারিখে,তাওরাত ছয় তারিখে,যবুর বার তারিখে, ইন্জিল আঠার তারিখে, এবং কুরআন শরীফ চব্বিশ তারিখ অতিবাহিত হওয়ার পর পঁচিশের রাত্রিতে অবতীর্ণ হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য বর্ণনায় ভিন্নমতও রয়েছে।{কুরতুবী, মাআরেফুল কুরআন-১২৩৫পৃষ্ঠা।}

২. ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল রমজান মাসেই ঃ ইতিহাস এ কথার সাক্ষী যে, সত্য মিথ্যার মধ্যে, হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী বদর যুদ্ধ এ মাসেই সংঘটিত হয়। অতএব, বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা বাতিলের বিরুদ্ধে যেমনি ছিল আপোসহীন, তেনি আমাদেরও আজ অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে থাকতে হবে বজ্রকঠোর। অন্যায় আর অসত্যকে যাতে আমরা সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারি, রমজান মাসে সংঘটিত বদরের যুদ্ধ আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে গেছে।

৩. ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের মাস এ মাহে রমজান ঃ রমজানের ঐতিহাসিক সে দিন সিয়াম সাধনায় মাশগুল মুসলমানরা ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে মক্কা অভিযানে বের হয়েছিলেন আল্লাহর রাসূলের সফর সঙ্গী হয়ে। সুতরাং মুসলিম হিসেবে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরার প্রত্যয় আমাদের গ্রহণ করতে হবে এ রমজান মাসে।
এ সব সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে রমজান প্রতি বছর আসে। শরীয়াত এ মাসে সিয়াম ফরয করেছে, রাতের সালাত ও তিলাওয়াতে কুরআনের ব্যবস্থা করেছে, যাতে করে মুমিনদের মধ্যে জিহাদের প্রাণশক্তি নিষ্প্রাণ না হয়ে পড়ে, বছরে অন্তত একবার রমজান মাসে কুরআন শুনে বা পড়ে আপন পদ মর্যাদা ও দায়িত্বপূর্ণ অনুভূতি সহকারে মনের মধ্যে ব্যাখ্যা করতে পারে। কুরআনের নাযিল হওয়া, তার অধ্যয়ন এবং সিয়ামের মুজাহিদ সুলভ তারবিয়াত এ জন্যে যে, ইসলামের সন্তানগণ দ্বীনকে বিজয়ী ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই জীবিত রয়েছে এবং কখনো যেন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফিল না হয়।{আসান ফিকাহ – মাওলানা ইউসুফ ইসলাহী}

সিয়ামের বিধান কখন ফরয হয়
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের পূর্বে তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণ মক্কায় মাঝে মাঝে নফল সিয়াম পালন করতেন। তাঁদের মদীনায় হিজরত করার দেড় বছর পর্যন্ত সিয়াম ফরয হয়নি। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসে তিনটি এবং আশুরার দিনে একটি করে সিয়াম পালন করতেন। হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে শাবান মাসের ২৮ তারিখ সোমবার পুরো রমজান মাসের সিয়াম ফরয হয়। {নাইলুল আওত্বার, ২য় খন্ড, ৪৯৯ পৃষ্ঠা।}

সিয়াম ফরয হওয়ার দলীল ঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
ياَيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اكُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-
“হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমন করে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার”
{সূরা আল বাকারা -১৮৩।}

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন :
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে”। {সূরা আল বাকারা -১৮৫।}

সিয়ামের শরয়ী মর্যাদা ও সিয়ামের হুকুম:
সিয়াম ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। ইহা ফরয, শরীয়তের কোন ওজর ব্যতীত ইহা তরক করা কঠিন কবীরা গুনাহ। সিয়ামের অস্বীকারকারী কাফির হবে। আর যে বিশ্বাস করে কিন্তু পালন করে না সে ফাসিক। সিয়ামের গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওজর ব্যতীত অথবা কোন রোগ ব্যতীত রমজানের একদিনের সিয়াম পরিত্যাগ করবে সে যদি সারা জীবন ধরে সিয়াম পালন করে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না।
{ মুসনাদে আহমাদ, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে আবু দাউদ।}
এ মর্মে ইমাম যাহাবী রহ. বলেন- এ কথা মুমিনদের কাছে সুবিদিত সত্য যে, যে ব্যক্তি অসুস্থতা তথা শরয়ী ওজর ব্যতীত সিয়াম বর্জন করে, সে ব্যভিচারী ও মাদকাসক্ত নেশাখোরের চেয়েও খারাপ। সে আসলে মুসলমান কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তার চরম অধঃপতন ও ঈমান শূণ্য হওয়ার ব্যাপারে ধারণা করা হয়ে থাকে।

সিয়ামের উদ্দেশ্য ও প্রকৃত সিয়ামের স্বরূপ

সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ
“যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণ হাসিল করতে পার বা মুত্তাকী হতে পার”।

তাই সিয়ামের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া সৃষ্টি করা। তাকওয়া মানব জাতির জন্য একটি মৌলিক গুণ বিশেষ। তাকওয়া এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয়। আল্লাহ তায়ালার সত্তার উপর ঈমান, তাঁর গুণাবলী, দয়া অনুগ্রহের গভীর অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তাঁর অন্যগুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া, যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়। আর সিয়াম আল্লাহর সত্তার উপরে দৃঢ় বিশ্বাস এবং তার অনুগ্রহ ও অসন্তোষের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে।
সিয়ামের এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসিল করা যেতে পারে, যখন পূর্ণ অনুভূতির সাথে সিয়াম পালন করা হয়। এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে সিয়ামকে রক্ষা করা হয়, যার প্রভাবে সিয়াম প্রাণহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত সিয়াম তো তাই যার সাহায্যে মানুষ তার মন-মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তুমি যখন সিয়াম পালন করবে, তখন তোমার কর্তব্য হবে তোমর কান, চোখ, মুখ, হাত,পা, এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর অপছন্দীয় কাজ থেকে বিরত রাখা। {কাশফুল মাহজুব, আসান ফিকাহ।}

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন,
مَنْ لَّـمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّوْرِ وَالْعَمَلَ بِه فَلَيْسَ لِلّٰهِ حَاجَةٌ اَنْ يَدَعَ طَعَامَه وَشَرَابَه
“যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলোনা, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই”।{সহীহ আল বুখারী}

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهٖ اِلَّاالظَّمَاءُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهٖ اِلَّا السَّهْرُ
“অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যারা ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাড়া কোন কিছু পায়না। আবার এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছে যারা রাত জেগে ইবাদত করে কিন্তু তাদের অনিদ্রা ব্যতীত কোন কিছুই পায় না”। {দারেমী, মিশকাতুল মাসাবীহ}

মুমিনের জীবনে রমজান ও সিয়ামের সুমহান শিক্ষা :

রমজানুল মুবারক মুমিনের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। এমাসে সিয়াম সাধনা একটা দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স, আর এ প্রশিক্ষণের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন, আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করা। দীর্ঘ এক মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদের আনন্দ। আর এ আনন্দের সাথে সাথে যেন রমজানের শিক্ষাগুলি ভুলে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে। সুতরাং মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন, ইহকালীন ও পরকালীন জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে গড়ে তোলার নিমিত্তে রমজানুল মুবারকের দীর্ঘ একমাস ব্যাপী কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সিয়াম সাধনা সহ আনুষঙ্গিক ইবাদতের মাধ্যমে আমরা যে প্রশিক্ষণ পাই তা বছরের অন্যান্য মাসেও বাস্তবে রূপদান করা প্রত্যেকটি মুসলমানের জন্যে অপরিহার্য কর্তব্য। পাঠকদের খেদমতে রমজান ও সিয়ামের কতিপয় শিক্ষা তুলে ধরা হচ্ছে।

১. সিয়াম মুমিন জীবনের প্রত্যেক কাজে আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামী করার অভ্যাস সৃষ্টি করে ঃ যে কোন অবস্থায় আল্লাহর বিধান মেনে চলার জন্যে প্রস্তুত থাকে। কেননা সিয়াম পালনের এ কঠিন নির্দেশ আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। মুমিনেরা তাঁরই নির্দেশ পালনার্থে কঠোর পরিশ্রম করে সিয়ামের মত কঠিন ইবাদত পালন করছে। দুনিয়ায় কোন রাজা-বাদশা বা শক্তিধর কোন লোকের নির্দেশে পালন করছেনা। অতএব, আল্লাহর নির্দেশের মাধ্যমে ঈমানদার ব্যক্তিগণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নিরংকুশ গোলামী করার জন্য অভ্যস্ত হয়ে উঠে।

২. তাকওয়া ও পরহেযগারীর জিন্দেগী নসীব হয় ঃ সিয়াম হচ্ছে গোপন ইবাদত। ইহা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানতে পারে না। রোযাদার গোপনেও কিছু খায়না বরং সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহর ভয়েই মানুষ রোযা রাখে। এভাবে দীর্ঘ ত্রিশ দিনের সিয়ামের মাধ্যমে সিয়ামপালনকারীর মনে আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়। আর এ তাকওয়া তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধি-নিষেধ পালনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তাকওয়া মূলত: মানব মনের সেই অবস্থাকেই বলা হয় যা আল্লাহর গভীর ভীতি ও প্রবল দায়িত্বানুভূতির দরূন সৃষ্টি হয় এবং জীবনের প্রত্যেকটি দিকে স্বতস্ফুর্ত ভাবে আত্ম প্রকাশ করে। আর এই তাকওয়াই হচ্ছে মুমিনের সম্মান ও ইজ্জতের মানদন্ড। ইরশাদ হচ্ছে
اِنَّ اَكْرَ مَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقاَ كُمْ-
নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সব চাইতে সম্মানিত ঐ ব্যক্তি যিনি তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেযগার”

৩. সিয়াম শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার শিক্ষা দেয় ঃ সিয়াম হচ্ছে একটা ব্যতিক্রমধর্মী ইবাদত। অন্যান্য ইবাদতের মতো লোক দেখানোর জন্য এটি করার কোন সুযোগ নেই। হাদীস শরীফে আছে প্রত্যেক মানুষের ভাল কাজের বদলা দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়া হয়, আল্লাহ বলেন সিয়াম এর ব্যতিক্রম। কেননা, সিয়াম খাস করে আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো। বান্দা আমার কারণেই কামনা-বাসনা ও পানাহার বর্জন করে থাকে।

৪. সিয়াম মুমিনকে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায় ঃ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে যাবতীয় অন্যায় এবং অসত্য চিন্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকার মানসিকতা সৃষ্টি করে এবং ব্যক্তিকে সকল প্রকার অন্যায় ও গর্হিত কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায়। কেননা, সিয়াম পালনকারী তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে নফসের সাথে লড়াই করে সিয়াম পালন করে। তাই রোযাদারদের রোযার মাধ্যমে এমন এক মুজাহাদানা (সংগ্রামী) জিন্দেগী নসীব হয়, যে জিন্দেগীর সকল ক্ষেত্রে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সে সংগ্রাম করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

৫. সহানুভূতি, সমবেদনা, সংবেদনশীল ও সহমর্মিতার শিক্ষা লাভ ঃ সিয়াম মানুষকে অন্যের দুঃখ-কষ্ট ও ব্যথ্যা-বেদনায় সংবেদনশীল, সমব্যথী ও সহমর্মী করে তোলে। কারণ, সিয়াম পালনকারী নিজে উপবাস থাকার দরূন অন্যের যে কোন দুঃখ কষ্টের কথা বুঝে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬. সিয়াম মানুষকে আত্মসংযমে অভ্যস্ত করে ঃ ভালো মানুষের অন্যতম আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসংযমী হওয়া। লোভ লালসা, কামনা-বাসনা ও দেহের অন্যান্য দাবির গোলামে পরিণত না হয়ে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করার নামই আত্মসংযম। সিয়ামের দ্বারা তা যথাযথ ভাবেই সিয়ামপালনকারীর মধ্যে অর্জিত হয়।

৭. সিয়াম সদাচারণ ও শালিনতার প্রশিক্ষণ দেয় ঃ রোযাদারের জন্য যে সব বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে তার অন্যতম হলো রোযা অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশ্লীল ও মূর্খতাপূর্ণ কথা না বলে, ঝগড়া ও গালমন্দ না করে। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে, আমি একজন রোযাদার।

৮. ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয় সিয়াম ঃ সুন্দর সমাজ গঠনের যারা কাজ করবে, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দায়িত্ব পালন করবে, তাদেরক অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। রোযা মানুষকে ধৈর্যশীল হিসেবে গড়ে তোলে। সারা দিনের উপবাস এবং রাতের বেলার দীর্ঘ ইবাদতের মাধম্যে অনুরূপ প্রতি ক্ষেত্রে রোযা মানুষকে ধৈর্যের অনুশীলনের মাধ্যমে উত্তম ধৈর্যশীল হিসেবে গড়ে তোলে । ধৈর্যশীল ব্যক্তিরা দুনিয়াতে যেমন সফল হয় তেমনি আখিরাতেও সফল হবে।

৯. সিয়াম সমাজে শান্তি-শৃংখলা আনে ঃ রোযা সমাজে শান্তিকামী ও শান্তিপ্রিয় লোক তৈরী করে। রোযার মাধ্যমে মুমিনগণকে আল্লাহর পথে মজবুত ভাবে আকড়ে ধরতে ও নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রয়োজন হলে নিজের আবেগ-উচ্ছাস অনুভূতি, প্রবৃত্তি ও ক্ষুধা তৃঞ্চার উপর একজন কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে এতে তারও মহরা হয়ে যায়। ফলে আবেগ উচ্ছাসের বশবর্তী হয়ে সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টির লোক কমে যায়। সমাজে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

১০. সিয়াম দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্বুদ্ধ করে ঃ দরিদ্রতা সমাজ জীবনে নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করে । তাই সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচী গ্রহণ করা জরুরী। রোযা ধনী বিত্তবানদের মনে দরিদ্রের প্রতি সহানুভূতির ভাব সৃষ্টি হয়, কারণ তারা বুঝতে পারে ক্ষুধার কি তাড়না। ধনীরা এমাসেই সাধারণত যাকাত আদায় করে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে প্রচুর খাদ্য সামগ্রী ও সচ্ছলতা দান করেছেন তাদের উচিৎ সমাজের দরিদ্র ও অনাহারক্লিষ্ট লোকদের আল্লাহর দেয়া খাদ্য সামগ্রীতে শরীক করা ও গরীবদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা এবং গরীবদের সাহরী ও ইফতারের ব্যবস্থা করা।

১১. সিয়াম সমাজে দানশীল লোক তৈরী করে ঃ রোযা মানুষের মধ্যে দানশীলতার গুণ সৃষ্টি করে এবং কৃপণতা দূর করে। কারণ, রোযার মধ্যে দান-খয়রাত করলে অন্য মাসের তুলনায় বহুগুণ সাওয়াব। তাই এই মাসে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে দান-সদকা বেশী বেশী করে। আর এ অভ্যাস সারা বছরের জন্য মানুষকে দানশীল করে গড়ে তুলে।

১২. সিয়াম নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা শেখায় ঃ নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা মানব জীবনের একটি মহৎগুণ। নিয়মানুবর্তিতার গুরুত্ব উপলব্ধি না থাকলে কোন মানুষ জীবনে সফলতা লাভ করতে পারে না। জীবনে উন্নতি করতে চাইলে জীবনের প্রতিটি মূহুর্তে সময়ের গুরুত্ব দেয়া একান্ত প্রয়োজন। সালাতের মত সিয়ামও আমাদেরকে সময় মত কাজ করার বাস্তব প্রশিক্ষণ দেয়। সময়ের পরে সাহরী খেলে এবং সময় হওয়ার পূর্বে ইফতার করলে সিয়াম শুদ্ধ হবে না, তাই সিয়াম সময়মত কাজ করার অভ্যাস সৃষ্টি করে এবং মানুষকে সময়ানুবর্তী হতে শেখায়।

১৩. সিয়াম হালাল রুজি অন্বেষনে পরিশ্রমী ও কর্মঠ হতে শেখায় ঃ সিয়াম মানুষকে জড়তা, অলসতা, ও আরম প্রিয়তা ঝেড়ে ফেলে কর্মঠ ও পরিশ্রমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। সিয়ামের দৈনন্দিন কার্যসূচী মানুষকে এ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। রমজানের দিনের বেলা সিয়াম পালন, দীর্ঘরাত জেগে তারাবীর সালাত আদায় করা এবং সাহরী খাওয়ার জন্য পুনরায় শেষ রাতে উঠা, তারপর আবার ফজরের নামায আদায়, দিনের বেলা নিজ নিজ কার্য সম্পাদন ইত্যাদি সব মিলিয়ে রোযার রাত দিন বড়ই পরিশ্রমের। রোযাদার হয়ে পরে এই পরিশ্রমে অভ্যস্ত। এভাবে দীর্ঘ এক মাসের অভ্যস্ততা রোযাদারকে জীবন-জীবিকার তাগিদে জীবন যুদ্ধে কাঠোর থেকে কঠোর পরিশ্রমে অবতীর্ণ হওয়ার প্রেরণা যোগায়। উদ্বুদ্ধ করে হালাল উপায়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে আরো সচেষ্ট হতে, আরো পরিশ্রমী হতে শেখায়। রোযার এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যদি তার প্রতিটি সময় কাজে লাগায়, তাহলে এ শ্রম জাতীয় উন্নয়নে উল্লেখ যোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

১৪. কুরআন তিলাওয়াত ও অধিক ইবাদতের সুঅভ্যাস গড়ে উঠে ঃ রমজানের ইবাদতের দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন শ্রবণ করা, এবং রাত জাগরণ করে অধিক ইবাদতের প্রেরণা পেয়ে থাকেন একজন রোযাদার।

১৫. দুনিয়া ত্যাগের নিদর্শন পাওয়া যায় রমজানে ঃ এ দুনিয়ার মায়া যতই বেশি হোক না কেন, কেউ এখানে চিরদিন থাকতে পারবে না বরং সকলকেই এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরপারে যেতেই হবে। কিভাবে সব কিছ ছেড়ে দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে তার একটা মহড়া বা প্রশিক্ষণ এ রমজান মাসে হয়ে থাকে। আর সেই দুনিয়া ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো রমজানের শেষ দশদিনের ই’তিকাফ।

১৬. সিয়ামের দ্বারা স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রশিক্ষণ হয় ঃ রোযা পালনের মাধ্যমে রোযাদারদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রিত হয়। যার ফলে স্বাস্থ্যরক্ষা সহ বহু রোগ নিয়ন্ত্রিত হয়। যে বাস্তব সত্যটি আজ মুসলমান-অমুসলমান সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন।

১৭. অধীনস্তদের প্রতি সদয় হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায় এ রমজানে ঃ কর্তৃত্বশালী ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রেই অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার, জুলুম এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে তাদের প্রতি অবিচার করে থাকে। এটি একটি অন্যায় আচরণ। রোযা অধীনদের প্রতি বাড়াবাড়ি না করে সদয় আচরণের নির্দেশ দেয়। হাদীসে এসেছে, এমাসে যে ব্যক্তি অধীনস্তদের দ্বায়িত্ব লাঘব করে দেয়, আল্লাহ তা’য়ালা তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন।

১৮. সর্বত্র অন্যায় ও অপকর্ম বর্জনের শিক্ষা পাওয়া যায় ঃ রোযার মূল শিক্ষাই হলো অনাচার ও পাপাচারকে বর্জন করা। সাওম বা সিয়াম শব্দের অর্থ হলো বিরত থাকা বা বর্জন করা। তাই রোযা অবস্থায় রোযাদারকে তার দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। অর্থাৎ তার মস্তিষ্ককে অন্যায় চিন্তা থেকে, চোখকে অন্যায় দেখা থেকে, নাককে অন্যায় ঘ্রাণ থেকে, জিহবা কে অন্যায় বলা থেকে, হাতকে অন্যায় কাজ ও অন্যায় লিখা থেকে, পেটকে দিনের বেলায় সর্বপ্রকার এবং অন্যান্য সময় হারাম পানাহার থেকে, যৌনাঙ্গকে দিনের বেলায় স্ত্রী এবং অন্যান্য সময় অপর নারী থেকে, এবং পা-কে অন্যায় হাটা-চলা থেকে বিরত রাখতে হবে।

১৯. স্বচ্ছতা ও জবাব দিহিতার শিক্ষা পাওয়া যায়ঃ রোযা স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন জীবনের অধিকারী হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় এবং জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি জাগ্রত করে। সুতরাং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সম্পন্ন এবং দুর্নীতি মুক্ত সৎ মানুষ গড়ার জন্য রোযার প্রশিক্ষণ একটি কার্যকর ব্যবস্থা। রোযার এ শিক্ষাকে কাজে লাতে পারলে দুর্নীতি মুক্ত সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব।

২০. মুসলামনদের মাঝে সংহতি ও ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের পূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়ঃ এক মাস ব্যাপী এক সাথে রোযা পালন, ইফতার গ্রহণ, সাহরী খাওয়া এবং জামায়াতে তারাবীর সালাত আদায় করা সহ রমজানের প্রতিটি ইবাদত অনুষ্ঠান মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ জীবন যাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
অতএব, রমজানের উপরোক্ত শিক্ষাগুলোর আলোকে আমাদের বাস্তব জীবনকে গঠন করতে পারলে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বৃহত্তর অঙ্গনে উন্নতি, অগ্রগতি, সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি,স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা অর্জন সহ আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য লাভে আমরা ধন্য হতে পারবো। তাই আসুন! রমজানের শিক্ষার আলোকে আমাদের বাস্তব জীবনকে গঠন করতে সকলে সচেষ্ট হই। মহা পরাক্রমশালী দয়াময় আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

Check Also

সাতক্ষীরাসহ বিভিন্নস্থানে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

সাতক্ষীরাসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে  সোমবার, ১২ রবিউল আউয়াল ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য ও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়েছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।