বিদেশ ডেস্ক১২:১৯, জুন ০৮, ২০১৭
বাংলাদেশিদের দৃষ্টি তিন প্রার্থীর দিকে
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ১৪ বাংলাদেশি প্রার্থিতা পেলেও ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে তিন নারী প্রার্থীর নাম। আগেরবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হওয়া এ তিন বাংলাদেশি প্রার্থী বৃহস্পতিবারের (৮ জুন) নির্বাচনেও সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। এরইমধ্যে অনেকে তাদেরকে ‘তিন কন্যা’ হিসেবেও অভিহিত করছেন। তারা হলেন- টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, রুশনারা আলী এবং রূপা হক। তিনজনই বিরোধী দল লেবার পার্টি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
২০১৫ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেই নির্বাচনে রেকর্ড বিজয় অর্জন করেন টিউলিপ, রুশনারা ও রূপা। এবার আগাম নির্বাচনে বাংলাদেশি প্রার্থীর সংখ্যা আরও তিনজন বেড়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১৪ জন প্রার্থীর মধ্যে ৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন লেবার পার্টি থেকে, একজন লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি থেকে এবং ৪জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে জয়ের সম্ভাবনার দিক থেকে অন্য বাংলাদেশি প্রার্থীদের চেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, রুশনারা আলী এবং রূপা হক ভালো অবস্থায় রয়েছেন। দুই বছর আগে তারা যে আসনগুলো থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবারও সেইসব আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক লন্ডনের মিটচ্যামে ১৯৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এবং রাজনীতি, নীতি ও সরকার বিষয়ে- দুইটি মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক আবারও লন্ডনের ‘হ্যাম্পসটেড এ্যান্ড কিলবুর্ন’ আসনটির জন্য লড়ছেন। টিউলিপের প্রতিদ্বন্দ্বিরা হলেন- লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির ক্রিস্টি এ্যালান, কনজারভেটিভ পার্টির ক্লেয়ার লুইস লেল্যান্ড, গ্রীন পার্টির জন ম্যানসক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হুফ ইস্টারব্রুক ও রেইনবো জর্জ ওয়েইস। ২০১৫ সালে টিউলিপ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিনের ছায়া মন্ত্রিসভায় নিযুক্ত হন। চলতি বছরের শুরুতে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট বিলের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে তিনি লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
আবারও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে গত এপ্রিলে টিউলিপ বলেন,‘হ্যাম্পসটেড ও কিলবার্ন এলাকার সবার জন্য কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে চাই। আমার কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে সব সময় স্থানীয়রাই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি সরাসরি ডেভিড ক্যামেরন ও থেরেসা মে-কে চ্যালেঞ্জ করেছি। যদিও অনেকেই পার্লামেন্টে পেছনের সারিতে বসে থাকতেন। জুনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে চুক্তি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের লোকবল ছাঁটাই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নাগরিকদের নিরাপত্তা, নারীদের সমানাধিকার ও অন্যান্য স্থানীয় বিষয় সামনে তুলে ধরেছি।’
রুশনারা আলী বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ‘বেন্থাল গ্রিন এ্যান্ড বো’ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন- কনজারভেটিভ পার্টির চার্লোট চিরিকো, লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির উইলিয়াম ডায়ার, গ্রীন পার্টির এ্যালিস্টার পোলসন, ইউকেআইআইপি’র ইয়ান ডি উলভেরন এবং স্বতন্ত্র আজমল মনসুর। রুশনারা আলী ২০১০ সালে প্রথম ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য। ২০১৫ সালে তিনি পুননির্বাচিত হন। তার পূর্বসূরীরা বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন।
গত এপ্রিলে নির্বাচনি প্রচারণা প্রসঙ্গে রুশনারা বলেছিলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিশুদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা, ২০২০ সালের মধ্যে বেঁচে থাকার মতো মজুরি সাপ্তাহিক ন্যূনতম ১০ পাউন্ড করা এবং রাষ্ট্রীয় সেবার জন্য আমি প্রচারণা চালাবো। সর্বোপরি, ব্রেক্সিটের সময়ে আমি স্থানীয় সেবা, কর্মসংস্থান ও বাণিজ্য রক্ষা করতে চাই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের থাকার পক্ষে এবং ব্রেক্সিট বিলের বিপক্ষে আমি ভোট দিয়েছিলাম। থেরেসা মে-র ব্রেক্সিট যা স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ও জাতীয় সমৃদ্ধিকে ঝুঁকি মধ্যে ফেলবে, তার বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে রূপা হক ‘ইয়ালিং সেন্ট্রাল এ্যান্ড এ্যাক্টন’ আসন রক্ষার জন্য লড়ছেন। তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন- কনজারভেটিভ পার্টির জয় মরিসে এবং লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টির জন বল। রূপা হক প্রথমবার ব্রিট্রিশ পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন ২০১৫ সালে। তার পূর্বসূরীদের আবাসস্থল বাংলাদেশের পাবনা জেলায়।
যুক্তরাজ্যের একটি ভোটকেন্দ্র
স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৮ জুন) সকাল সাতটা এবং বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা থেকে ভোট দিতে শুরু করেন ব্রিটিশ জনগণ। আর ভোটগ্রহণ শেষ হবে ব্রিটিশ সময় রাত ১০ টায়। অবশ্য, যুক্তরাজ্যের নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কোনও ভোটার যদি লাইনে দাঁড়ানো থাকেন তবে নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার ভোটটি গ্রহণ করা হবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশজুড়ে ৪০ হাজারেরও বেশি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলছে। এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জন্য ৬৫০ জন এমপিকে বেছে নেবেন তারা। আগের বছরের চেয়ে এবারের ভোটার সংখ্যা বেশি। ২০১৫ সালে ৪ কোটি ৬৪ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র হিসেবে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, প্যারিশ হলকে ব্যবহার করা হচ্ছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ম্যানচেস্টার ও লন্ডনে হামলা হওয়ায় নির্বাচনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
মেট্রোপলিটন পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রত্যেক লন্ডন বরোতে সুনির্দিষ্ট করে পুলিশি অভিযান চলবে। লন্ডনজুড়ে বিশেষায়িত এবং উচ্চ পর্যায়ের অভিযানের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনও সময় তা পরিচালনা করা হবে।’
হাউস অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হলে একটি দলকে অন্তত ৩২৬টি আসনে জয়ী হতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে, মধ্যরাত নাগাদ কয়েকটি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। আর শুক্রবার দুপুর নাগাদ পাওয়া যাবে চূড়ান্ত ফলাফল।
দেড় মাসের নির্বাচনি প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতি-পর্ব শেষে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের রায়ের মুখোমুখি হবে। ১৯৭৪ সালের পর ব্রিটেনে এটিই প্রথম আগাম নির্বাচন।
গত বছর ব্রেক্সিট গণভোটের পর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সরে দাঁড়ান। ফলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর তিনি টোরি সরকারের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ছাড়ার প্রস্তাব দেওয়ার পর তিনি আগের অবস্থান থেকে সরে এসে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
আগাম নির্বাচনের প্রচারণার শুরুতে ভালো ব্যবধানেই এগিয়ে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। গত মাসে লেবার পার্টির চেয়ে ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন কনজারভেটিভরা। কিন্তু নির্বাচনের দুইদিন আগে দুই দলের রেটিং ব্যবধান কমে মাত্র এক পয়েন্টে দাঁড়ায়। তবে ভোট গ্রহণের আগেরদিন অর্থাৎ বুধবার পরিচালিত সর্বশেষ কয়েকটি জনমত জরিপে মিশ্র ফল পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ জরিপে নাটকীয়ভাবে কনজারভেটিভদের এগিয়ে থাকার কথা বলা হচ্ছে। সর্বশেষ ৫টি জরিপে দেখা গেছে, দুটিতে ব্যাপক ব্যবধানের কতা বলা হয়েছে, দুটিতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দেওয়া হয়েছে এবং একটিতে পূর্বাভাস অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ইউগভ-এর জরিপে বলা হয়েছে চূড়ান্ত জরিপে লেবার পার্টি তিন পয়েন্ট পিছিয়ে গেছে। গার্ডিয়ান-আইসিএম-এর জরিপের পূর্বাভাস অনুযায়ী থেরেসা মের দল ১২ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে করবিনের দলের তুলনায়। তাদের মতে, কনজারভেটিভরা ৪৬ ও লেবার পার্টি ৩৪ শতাংশ ভোট পাবে। জরিপগুলোতে দাবি করা হয়েছে, দোদুল্যমান (সুইং ভোট) ভোটাররা থেরেসা মে’র দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ইনডিপেন্ডেন্ট-কমরেস পরিচালিত জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছে, থেরেসা মে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবেন। এমনকি মার্গারেট থ্যাচারের পর সবচেয়ে বেশি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারেন কনজারভেটিভরা। তবে ক্রিয়াসলি নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে লেবার পার্টি ৩ পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে কনজারভেটিভদের তুলনায়। এ জরিপের ফল অনুসারে, লেবার পার্টি ৪১.৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে। আর কনজারভেটিভরা পাবে ৩৮.৫ শতাংশ ভোট। কোম্পানিটি জানিয়েছে তাদের মার্জিন অব এরর হতে পারে ৩.২ শতাংশ।