ব্রিটিশ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে। ভোটের শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নির্বাচনি জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এসব জরিপের ফলাফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। একেবারে শেষ মুহূর্তের জরিপগুলোতে নাটকীয়ভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র কনজারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে বলে দাবি করা হচ্ছে। অথচ একদিন আগের জরিপগুলোতে আভাস পাওয়া গিয়েছিল জেরেমি করবিনের লেবার পার্টি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করবে। আবার সব জরিপই যে, থেরেসা মে-কে এগিয়ে রাখছে তা নয়। ফলে থেরেসা বা করবিন কেউই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেন না বলেই বেশিরভাগ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের নির্বাচনি পুর্বাভাসে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়েছে, এবারের নির্বাচনে যুক্তরাজ্য ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেতে পারে। ইউগভ-এর জরিপের ফলাফলের সূত্র ধরে পত্রিকাটি বলছে, কনজারভেটিভরা ২৭৪ থেকে ৩৪৫টি আসন পেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে ৩১০টি আসনে জয়ী হতে পারে দলটি। যা গত নির্বাচনের চেয়ে কম। গত নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ৩৩০টি আসন। আর লেবার পার্টি পেতে পারে ২৫৭টি আসন। জরিপ অনুসারে, এসএনপি ৫০, এনআই ১৮, লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ১০টি আসনে জয়ী হতে পারে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হলে একটি দলকে অন্তত ৩২৬টি আসনে জয়ী হতে হবে। ফলে নির্বাচনি এই জরিপে কোনও দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পক্ষে যাচ্ছে না। যা দেশটিকে একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টের দিকেই ঠেলে দিতে পারে।
ঝুলন্ত পার্লামেন্ট ব্রিটেনের জন্য একেবারে নতুন নয়। সর্বশেষ ২০১০ সালেই কনজারভেটিভরা লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট গঠন করেছিল। এর আগে ১৯৭৪ সালে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট গঠন করে লেবার পার্টিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল কনজারভেটিভরা। অবশ্য, ওই পার্লামেন্ট বেশি দিন ঠেকেনি। মাত্র ৮ মাসের মাথায় নতুন নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯১০ ও ১৯২৯ সালেও ব্রিটেন ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেয়েছিল।
ঝুলন্ত পার্লামেন্ট মানেই জোট সরকার নয়। ব্রিটেনের সংবিধান অনুসারে ঝুলন্ত সংসদ মানে হচ্ছে হাউস অব কমন্সে কোনও একক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা। শুক্রবার ভোটের ফল ঘোষণার পর কোনও দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে থেরেসা মে-ই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। নতুন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত থেরেসা প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন। তবে সাধারণত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানো প্রধানমন্ত্রী বা তার দল সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন না। ফলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে জয়ী দল লেবার পার্টির নেতা হিসেবে জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবেন। এ কারণেই থেরেসা মে’র জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তা বেশি।
ব্রিটিশ ক্যাবিনেট ম্যানুয়াল অনুসারে, নতুন পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকবেন। পার্লামেন্ট বসার পর এমপিরা রাণির ভাষণের অনুমোদন দেবেন। এই হিসেবে ১৩ জুন পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হবে। সেই দিন পর্যন্ত থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
অবশ্য এটা একেবারে বাধ্যতামূলক নয়। ক্যাবিনেট ম্যানুয়াল অনুসারে দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীকে এই সময়ের মধ্যে পদত্যাগের প্রত্যাশা করা হয়েছে। ফলে নির্বাচনে কনজারভেটিভরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে তার পদত্যাগের দাবি তোলা হবে। পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ বিরোধীরা লেবার পার্টির করবিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। আর যদি থেরেসা মে পদত্যাগ করেন তাহলে সরকার গঠনের প্রথম সুযোগ পাবেন করবিন। হাউস অব কমন্সে এমপিদের সমর্থন প্রয়োজন হবে তার।
উল্লেখ্য, ব্রিটেনে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট আর জোট সরকারকে এক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। জোট বলতে ৩২৩ জন এমপি আছে এমন দুই বা ততোধিক পার্টির আনুষ্ঠানিক চুক্তিকে বোঝায়। চুক্তি অনুসারে সব দল থেকেই সরকারে মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত কনজারভেটিভ-লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা এভাবেই জোট সরকার গঠন করেছিল।
তবে এক্ষেত্রে বিকল্প ও ব্যতিক্রম রয়েছে। এমপিদের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী অন্য কোনও দল থেকে মন্ত্রী নিয়োগ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ছোট দলগুলোর উপর নির্ভর করতে পারেন। সরকারের আর্থিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন বাজেট ইত্যাদিতে ছোট দলগুলো সরকারকে সহযোগিতা করবে। অন্যথায় আস্থাভোটের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে পারে। ছোট দলগুলো মন্ত্রীত্ব পাবে না কিন্তু তারা তাদের নীতির উপর দাঁড়িয়ে সরকার পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারে।
ছোট জোট গঠনের আরেকটি বিকল্প রয়েছে দলগুলোর সামনে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দলটি ছোট দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট গঠন করে। কিন্তু সবমিলিয়ে তাদের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে না। ফলে তাদেরকে হাউস অব কমন্সে সবার ভোটের উপর নির্ভর করতে হয়। অনেক লেবার পার্টির নেতা মনে করেন, এবার লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে এমন জোট গঠন করা সম্ভব।
ঝুলন্ত পার্লামেন্টে সরকার সব সময় দুর্বল থাকে। যে কোনও সময় এমপিরা তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। সাধারণত এ ধরনের সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় ঠিকতে পারে না। আর যদি এসব বিকল্প কাজে লাগিয়ে কোনও সরকার গঠন সম্ভব না হয় তাহলে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অবশ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জরিপের ফলাফল অনেক সময় ভোটের দিন পাল্টে যায়। ফলে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। ফলে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষা করতে হবে।
উল্লেখ্য, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার (৮ জুন) সকাল সাতটা এবং বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা থেকে ভোট দিতে শুরু করেন ব্রিটিশ জনগণ। আর ভোটগ্রহণ শেষ হবে ব্রিটিশ সময় রাত ১০ টায়। অবশ্য, যুক্তরাজ্যের নির্বাচনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কোনও ভোটার যদি লাইনে দাঁড়ানো থাকেন তবে নির্দিষ্ট সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তার ভোটটি গ্রহণ করা হবে। শুক্রবার দুপুর নাগাদ পাওয়া যাবে চূড়ান্ত ফলাফল। সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ, ডেইলি মিরর, নিউ স্টেটসম্যান।