সিন্ডিকেটের কবলে সাতক্ষীরার আম বাজার, ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষীরা

সিন্ডিকেটের কবলে সাতক্ষীরার আম বাজার, ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষীরা
সিন্ডিকেটের কবলে সাতক্ষীরার আম বাজার, ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষীরাআবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: এবার বাম্পার ফলন হলেও সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে সাতক্ষীরার আম বাজার। পরিবহন, বিপনণ ও সংরক্ষণের অভাবে আমের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না চাষীরা। বাজারে ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে আম। এ ছাড়া দাদন মালিকদের যোগসাজসে প্রকৃত আম চাষীরা বিপাকে। এরই মধ্যে প্রায় ২০০ টন আম ইউরোপের বাজারে যাওয়ার পথে। হাত বাড়ালেই ঘরে ঘরে আর। জেলা ব্যাপি আম আর আম। হাট-বাজার সয়লাব আমে। কোথাও তেমন দাম নেই। হিমসাগর ও ল্যাংড়া ছাড়া বেশির ভাগ আমের দাম ১০ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। তাও আবার বিক্রি হচ্ছে না।

পরিবহন খরচ বেশি ও আম দ্রুত পেকে যাওয়াতে আম বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েছে চাষীরা।  জেলাতে এ মৌসুমে  প্রায় লক্ষাধিক মানুষ আম কেনা-বেচা করে সংসার চালান।  প্রশাসনের তেমন তদারকি না থাকায় ন্যয্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত আম চাষীরা।

আমে মুকুল ধরা থেকে শুরু  করে  আম বিক্রি পর্যন্ত কয়েক দফায় হাত বদল হয়। প্রথমে আম চাষীদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা আম বাগান ক্রয় করেন। মৌসুমি ব্যবসাসীরা আবার সেই টাকা দাদন (বাকিতে টাকা নেয়া) নেন মহাজনদের কাছ থেকে। আম উঠলে এসব আম মহাজনদের কাছে বিক্রি করতে হবে এমন শর্তে । এমন মহাজনদের সংখ্যা জেলাতে অনেক এবং জেলার বাইরে আরো কয়েক ডজন। জেলাতে মৌসুমি ব্যবসায়ির সংখ্যা প্রায় তিনশয়ের মত। আর ব্যক্তি পর্যায়ে আম চাষী প্রায় দশ হাজার।

আম উঠতে শুরু করলে বাজারের অদৃশ্য শক্তির ইশারায় দাম উঠতে থাকে। প্রকৃত পক্ষে দাম নির্ধারণ করে দেন দাদন মালিক মহাজনরা। ব্যক্তি পর্যায়ে আম চাষীদের আমে যখন বাজার সয়লাব হয়ে যায় তখন মাহজনরা আমের দাম কম দিয়ে দাম কমার বিভিন্ন অজুহাত দেয়। এভাবে  আমের বাজার নিয়ন্ত্রন নেয় গুটি কয়েক মাহজন। মহাজনরা জানালেন ভিন্ন কথা। একন মহাজন জানান মৌসুমি ব্যবসায়িরা বিনা লাভে তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আম বাগান কেনে। পরে বাজার দামে তাদের কাছ থেকে আমরা আম কিনি।

এরপর এসব আম ক্যারেট করতে কিংবা প্যাকে করতে খরচ হয় মনপ্রতি আরো ৫০ থেকে একশত টাকা । পরে পরিবহন, কুরিয়ার  কিংবা ট্রাকে করে ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করা হয় এসব আম। এ সুযোগে কুরিয়ার মালিকরা সিন্ডিকেট করে আম সরবরাহে কয়েকগুণ খরচ নেন। সাতক্ষীরা থেকে ঢাকাতে আম পৌঁছাতে মণ প্রতি বিভিন্ন কুরিয়ারে খরচ ৫শ টাকা থেকে ৮শ টাকা পর্যন্ত। অন্য জেলাতে আরো বেশি।

সাতক্ষীরার বিভিন্ন বাজার ঘুরে আম উৎপাদনে সিন্ডিকেটের কথা জানালেন কয়েক জন আম চাষী। রহমত মিয়া। সাতক্ষীরা বড় বাজারের একজন আম ব্যবসায়ি। তিনি ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলাতে সাতক্ষীরার আম পাঠান। তিনি জানান, বাজার থেকে আম কেনার পর মণ প্রতি পরিবহন খরচ ৪শ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত। তিনি প্রতিদিন এক ট্রাক করে আম  ঢাকাতে পাঠান। প্রতিদিন সাতক্ষীরা থেকে ছোট বড় ১০ থেকে ১৫ ট্রাক আম দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয়।

এই আম নিয়ে স্থানীয় চাষীরা ছন্দের আকারে বলে থাকেন,

‘পৌষে কুশী মাঘে বোল, ফালগুনে গুটি, চৈত্রে আঁটি, বৈশাখে কাটি-কুটি, জৈষ্ঠে চাটি-চুটি, আষাড়ে ফেলাই আঁটি, শ্রাবনে বাজায় বাঁশি’ এর অর্থ হলো পৌষ মাসে আম গাছে কুশি হয় মাঘ মাসে বোল ধরে, ফালগুনে আমেতে গুটিতে পরিণত হয়। চৈত্রে মাসে আঁটি হয়। বৈশাখে কাঁচা আম আমরা কেটে-কুটে খায়। জৈষ্ঠি মাসে আমরা পাকা আম চেটে চুটে খায়। আষাড় মাসে আমরা আমের আঁটি ফেলে দেই। শ্রাবন মাসে আঁটিতে যখন গাছ গজায় তখন কিশোর-কিশোরিরা বাশি বাজায়। এমনি ভাবে বছর যায় আম চাষে।

সাতক্ষীরার ১০০ হেক্টর জমির ওপর অবস্থিত ৩৭৭টি বাগানের প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার গাছের আম ব্রিটেনে রপ্তানির করা হচ্ছে। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়ায় সাতক্ষীরায় এবার আমের বাম্পার ফলন হয়েছে।

গত বছর এই জেলা থেকে ২৩ টন আম ব্রিটেনের বাজারে রপ্তানি হয়েছিল। এবছর কৃষি বিভাগ যাচাই-বাছাই করে সদর উপজেলার ১৫০টি, কলারোয়ার ১০০টি, দেবহাটার ৪০টি ও তালার ৮৭টি বাগান নির্বাচিত করা হয়। ১০০ হেক্টর জমির এসব আমবাগানের মালিক ২২০ জন। গাছের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪৫১টি। এসব বাগানে হিমসাগর, ল্যাংড়া ও আম্রপালি জাতের আমগাছ রয়েছে।

কৃষি বিভাগের তত্ত্ববধানে এসব বাগানে বিষমুক্ত আম উৎপাদনের কার্যক্রম চলে। এ প্রক্রিয়ায় বাগানগুলো থেকে ৬০০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে কৃষি বিভাগ জানান। যা থেকে বাছাই করে এ বছর ২০০ টন আম বিদেশে রপ্তানি করা যাবে বলে তাদের আশা।

এজন্য এ বছর কোয়ারেন্টাইনের এক্সপোর্ট ডিডি, বাংলাদেশ ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইসলাম এন্টারপ্রাইজ ও দীপ ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাসহ হার্টেক্স ফাউন্ডেশন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাতক্ষীরার আমবাগান পরিদর্শন করেছেন এফএও ফুড সেলের প্রোগ্রাম অফিসার মাইক ডিলন।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার আমের আবাদ করা হয়েছে তিন হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে, যা গতবারের চেয়ে ৫০ হেক্টর বেশি। আর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন; যা গতবারের চেয়ে ১৫ হাজার টন বেশি।

বাংলাদেশে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাদ দিলে আম উৎপাদনে সাতক্ষীরা জেলা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে সাতক্ষীরায় উৎপাদিত আম খুবই সুস্বাদু। তাছাড়া অন্যসব এলাকার আগে এ জেলার আম পাকে। সে কারণে এর কদর দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশের বাজারেও।

জেলাতে বিভিন্ন জাতের আম চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোবিন্দভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা, সিঁদুররাঙা, ফজলি, কাঁচামিঠা, বোম্বাই, লতাবোম্বাই বেশি চাষ হয়।

ফলন ও কদর ভালো হওয়ায় জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে নতুন নতুন আমবাগান। ফলে দিনে দিনে এ অঞ্চলে আমচাষ বেড়েই চলেছে। শ্রমিক দিয়ে সারা বছর পরিচর্যা করা হয় আমবাগান। এতে বহু লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে। বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিপুল অংকের টাকা।

দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইউরোপের বাজারেও এখন বাড়ছে সাতক্ষীরার আমের কদর। তাই ইতালি, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে সাতক্ষীরার হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম। তৃতীয় বারেমতো এবছর সাতক্ষীরার আম ইউরোপের বাজারে পাঠানো হয়েছে।

১৫ মে থেকে সাতক্ষীরার হিমসাগর আম গাছ থেকে পাড়ার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। বর্তমানে হিমসাগর আম শেষ পর্যায়ে । এখন বাজারে আসতে শুরু করেছে আম্রপালি।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জানান, আমে যাতে কেউ বিষাক্ত পদার্থ কারবাইট ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত সবসময় কাজ করছে। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।এছাড়া ইউরোপের বাজারে সাতক্ষীরার আমের কদর বাড়ছে।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী আব্দুল মান্নান বলেন, আমচাষীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার কারণে এবছর আমের ফলন ভাল হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।

Check Also

সাতক্ষীরা জেলা জলবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভা

শাহ জাহান আলী মিটন , সাতক্ষীরা :সাতক্ষীরা   জেলা  জলবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।সাতক্ষীরা জেলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।