মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
বদরের ঐতিহাসিক শিক্ষা- সর্বাগ্রে আল্লাহর উপর নির্ভরতাই বিজয় অর্জনের শর্ত
১৭ই রমজান ‘বদর দিবস’। ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের এই দিনটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদরের যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষার্থে, সত্যের পক্ষে, ইসলামের পক্ষে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের পক্ষে এবং মানবকল্যান নিশ্চিতের জন্য। দ্বিতীয় হিজরীতে সংঘটিত এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের ধারাবাহিক বিজয়ের সূচনা করেন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়, সেজন্যই এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল-কুরআনে এই দিনকে ইয়াওমূল ফুরক্বান বলা হয়েছে।
ইসলামে যুদ্ধের অনুমতি আসার পরে বদর যুদ্ধ ইসলামে প্রথম যুদ্ধের ঘটনা। আল্লাহ যুদ্ধের অনুমুতি দিয়ে বলেন-
“যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। …” (কুরআন ২২:৩৯-৪০)।
বদর যুদ্ধে মুসলমানগণ ছিলেন ৩১৩ জন, অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের অধিক। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি; বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আউস গোত্রের আর বাকি ৬৯ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। অপরদিকে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি। যুদ্ধক্ষেত্রটিতে মুসলমানেরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে পড়ে। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনের বেলায় সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম, যা যুদ্ধেক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অপর দিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলো সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি ছিলো উপযুক্ত।
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ সুরা আনফালের ৩৬ নং আয়াতে কাফিরদের যদ্ধের প্রস্ততি ও প্রত্যয় উল্লেখ করে এর পরিনতির কথা বলেন-
“নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা ব্যয় করে নিজেদের ধন-সম্পদ, যাতে করে বাধাদান করতে পারে আল্লাহর পথে। বস্তুতঃ এখন তারা আরো ব্যয় করবে। তারপর তাই তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হয়ে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যাবে।”
এরপর যুদ্ধ শুরু হবার পরে যখন তীব্র যুদ্ধ চলছে, তখন হজরত আবু বকর (রা.) দেখতে পেলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আর আল্লাহর দরবারে বলছেন : ‘হে আল্লাহ! হাতেগোনা মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই দুনিয়ার বুকে ইবাদতের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আপনার সেই সাহায্য অবতরণ করুন, যা দেয়ার অঙ্গীকার আপনি আমার সঙ্গে করেছেন।’
রাসূল সা. এর এই দোয়ার পরেই আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বলেন-
‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’। (সুরা আনফাল ৯)
যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদেরকে যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। অচিরেই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। (সুরা আনফাল ১২)
অতঃপর যুদ্ধে মহান আল্লাহ’র প্রতিশ্রুত সাহায্য আসে এবং বদরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার অর্থাৎ ১৪ জন শহীদ হন। অন্যদিকে কাফেরদের পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে (القليب) নিক্ষেপ করা হয়। তাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে বদর যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
এটি ছিল অলৌকিক বিজয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমরা (মুসলমানরা) তাদের হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছেন।’ (সূরা আনফাল : ১৭)
বদরের বিজয়ের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হ’তে পার’। (আলে ইমরান ৩/১২৩)
সূরা আল ইমরানের আলোচিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বদরের এই বিশাল বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে স্পষ্ট বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে তোমাদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন, সুতরাং একইভাবে সেসব ক্ষেত্রেও তিনি তোমাদের সাহায্য করতে সক্ষম, যখন আল্লাহর উপর ভরসা করে সততা ও ইখলাস সহকারে তাঁর দ্বীনের পতাকা বুলন্দ করার লক্ষ্যে তোমরা এগিয়ে যাবে।
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম সমন্বিত এবং সেসময়ের জন্য সম্ভবপর পরিকল্পিত যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় ছিল সব কিছুর জন্য সবার উপরে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল করা। এই যুদ্ধ প্রমান করে সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়, বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হল বিজয়ের মূল হাতিয়ার। এই যুদ্ধ মুসলমানদের শিখিয়েছে জাগতিক সকল প্রস্ততির পরেও সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহ’র ওপর। তবেই মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে এবং বিজয়লাভ বা সফল হওয়া সম্ভব হবে।
বদর যুদ্ধের পরই কাফিরদের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি। বরং অব্যাহত রয়েছে আজ পর্যন্ত। সুরা বাকারার ১১৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের এই প্রত্যয় সস্পর্কে বলেছেন-
‘বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়’।
সাথে সাথে মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সুরা আনফাল- ৩৯ এ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন-
‘এখন তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ফেতনা ফাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং সবাই একমাত্র আল্লাহর অনুগত না হয়ে যায়।’
সুতরাং বদরের থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন থাকবে সকল যুগে। বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলমানগণ সেই অকুতোভয় মুজাহিদ বদরের সৈনিকদের কথা স্মরণ করে নিজেরাও প্রয়োজনে বদরের মতো যুদ্ধে যেতে পারেন সেই শিক্ষাই আমাদের বদর দিবস থেকে নিতে হবে
http://www.shibir.org.bd/