প্রথমঅালোঃ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের মামলার যাঁরা সাক্ষী, তাঁদের কাটছে দুঃসহ ‘বন্দিজীবন’। যাঁদের আরজি ও সাক্ষ্যে সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে, তাঁরা এখন এক অনিশ্চিত ও অনিরাপদ জীবন কাটাতে শুরু করেছেন। এই বাস্তবতা পিরোজপুরের পাড়েরহাটের।
সাক্ষীরা বলছেন, এই অনিশ্চয়তা যতটা না প্রতিপক্ষ থেকে, তার চেয়ে বেশি পুলিশি নিরাপত্তার কবলে পড়ে। এক সাক্ষীকে হত্যা ও আরেকজনের বাড়িতে হামলার পর ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী সুরক্ষা আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষীদের জানমালের নিরাপত্তায় পুলিশ নিয়োগ করেছে রাষ্ট্র। কিন্তু পুলিশনির্ভর জীবন সাক্ষীদের স্বাভাবিক জীবন পাল্টে দিয়েছে। রাস্তাঘাটে চলাফেরা, হাটবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেড়ানো, সামাজিকতা—সবকিছুই বদলে গেছে।
৯৭ বছর বয়স্ক সাক্ষী মধুসূদন ঘরামি শ্লেষ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারাটা ক্ষণ পুলিশ দাঁড়ায়ে থাকে। রাইতে ঘুম থেকে তুলে ঘরের বাইরে যাইতে হয়। এটা কি কম যন্ত্রণা? এ রকম হবে বুঝলে কেউ সাক্ষী দিতে যাইত না।’
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রপক্ষের মামলার বাদী ও সাক্ষী মিলে নয়জন। এর মধ্যে খুনের শিকার হয়েছেন অন্যতম সাক্ষী মোস্তফা হাওলাদার। বাকি আট সাক্ষীর ছয়জনের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে কথা হয় ৪ জুন। অন্য দুজনের সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আটজন সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেয় দুই ফাঁড়ির পুলিশ। রাতে সাক্ষীদের ঘরেই থাকেন পুলিশ সদস্যরা। সাক্ষীদের একজনআবদুলহালিম খলিফা পেশায় পল্লিচিকিৎসক। পাড়েরহাটের বৌডুবিতে তাঁর ছোট্ট ওষুধের দোকান। আরেকজন গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা পাড়েরহাটে তেল-লবণ বিক্রি করেন। আর আবদুল জলিল শেখ পুরোনো রেডিও-টেলিভিশন সারানোর কাজ করেন পাড়েরহাটে।
আবদুল হালিম বলেন, ‘মোর ধারে এইভাবে পুলিশ থাকলে রোগী আইব? হেগো লইয়া বইয়া থাকি। রোগী আসে না।’ গৌরাঙ্গ চন্দ্র বলেন, ‘আগে ঘোষেরহাট, চিংড়িখালী, পাড়েরহাটে দোকান করতাম। মাসে ৩০ হাজার টাকা ইনকাম ছিল। এখন ১ হাজার টাকা বেচতেও কষ্ট হয়।’ কেন বেচতে কষ্ট হয়, জানতে চাইলে গৌরাঙ্গ বলেন, ‘এখানে বেশির ভাগ মানুষ জামায়াতের। আমি সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিছি, তাই আমার কাছ থেকে কিনে না।’
সাক্ষী আলতাফ, মাহতাব, জলিল শেখ ও মধুসূদন ঘরামির ভাষ্য, সরকার তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ এখন তাঁদের জীবনে যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশি পাহারায় তাঁদের স্বাভাবিক জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
আবদুল জলিল শেখ বলেন, ‘আমি এসপি (পুলিশ সুপার) সাহেবের পা ধইররা পুলিশের দোকানে আওন বন্ধ করছি। নইলে তো আমি মইররা যামু। সরকার আমারে মাইরালাক (মেরে ফেলুক)। আমি পুলিশ চাই না।’ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য আকাশ দে বলেন, ‘আমরা থাকলে ডিস্টার্ব হয়, কাস্টমার আসে না। তাই আমরা দূরে থাকি।’
সাক্ষীরা বলছেন, তাঁরা অজগাঁয়ের অতি সাধারণ মানুষ। এমন নিরাপত্তা তাঁদের জন্য নানা দিক থেকে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সরকারিভাবে সাক্ষীদের বাড়িতে পুলিশের থাকার ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে ঘরের একটি কক্ষে পুলিশকে থাকতে দিতে হচ্ছে।
বৌডুবিতে একজন সাক্ষীর ঘরে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর ছোট্ট দোচালা টিনের ঘরের মাঝখানে বেড়া দিয়ে এপাশ-ওপাশ করা হয়েছে। অন্য পাশের এক চৌকিতে থাকছেন তিন পুলিশ সদস্য। একজন পুলিশ সদস্য বলেন, তাঁর ভাষায়, ‘তিনজন লোক এক চৌকিতে থাকতে হয়। টয়লেটে সমস্যা। কষ্ট হলেও থাকি। করব কী।’
সরেজমিনে সাক্ষীদের বাড়িতে গিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ঘরোয়া পরিবেশে দেখা যায়। অনেকে আছেন উদাম গায়ে, লুঙ্গি পরে।
সাক্ষীরা বলছেন, সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় থাকায় তাঁদের পারিবারিক গোপনীয়তা বলতে আর কিছু থাকছে না। ঘরে নিত্য পুলিশ দেখতে দেখতে বাচ্চাদের ভয় উঠে যাচ্ছে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনেরা সাক্ষীদের বাড়ি যাওয়া-আসা কমিয়ে দিয়েছেন।
একজন সাক্ষীর প্রতিবেশী একজন নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাষায়, ‘ওই বাড়িতে সারাক্ষণ পুলিশ থাকে। এই কারণে আমরা যাওয়া বন্ধ করে দিছি। ভয়ে সাক্ষীকে সবাই এড়াই চলে। কেউ ওই পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া তো দূরের কথা, কথা বলতেও ভয় পায়।’
সাক্ষীদের প্রত্যেকেই বলেন, তাঁরা ইচ্ছে করলেই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে বা হাটবাজারে যেতে পারেন না। জীবনটা নিয়ন্ত্রিত ও পুলিশনির্ভর হয়ে গেছে। নিজ থানার বাইরে কোথাও যেতে হলে আগে থেকে পুলিশকে দরখাস্ত দিয়ে জানাতে হয়। কোথায় কার কাছে যাবেন, কতক্ষণ থাকবেন—সব জানাতে হয়, যাতে পুলিশ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারে। পুলিশ সদস্যদের যাতায়াত খরচ সাক্ষীদেরই বহন করতে হয়।
আবদুল হালিম খলিফা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘পাড়েরহাট গেছি বাজার করতে। বাজার করলাম ১০০ টাকা। পুলিশের জন্য রিকশা ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা।’
কয়েকজন সাক্ষী বলেন, তাঁরা আর পুলিশ নিরাপত্তা চান না। প্রত্যাহার চেয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তাঁরা বৈধ অস্ত্রের জন্য লাইসেন্স চেয়ে আবেদনও করেছেন। কিন্তু পাননি। অবশ্য আরেক সাক্ষী মানিক পশারী বলেন, ‘যে কয়দিন বাঁচি আমি পুলিশ চাই। ওরা (বিএনপি-জামায়াত) ফাঁকে পাইলে আমারে ছাড়বে না।’
কয়েকজন সাক্ষী জানিয়েছেন, সংসার ও সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চলছে না। বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়ে কোনোমতে চলছেন। মন্ত্রী-সাংসদেরাও খোঁজখবর নেন না। সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার বলেন, ‘প্রথম দিকে তাঁরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এখন খোঁজখবরও রাখেন না। এমপি সাহেব (এ কে এম এ আউয়াল) বলেন মঞ্জু (বনমন্ত্রী) সাহেবের কথা। এমন তো কথা ছিল না। দেশের জন্য কাজ করছি। এখন মনে হচ্ছে অভিশাপ।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, পিরোজপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল তিনজন সাক্ষীর নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এরা তো মেজর জিয়াউদ্দিনের লোক। একজন জেপি করে। তারা নিরাপত্তা চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। অর্থ সহযোগিতা করেছি। লাগলে আরও দেব। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে তো বাজারখরচ করে দিতে পারব না।’
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একা হয়ে গেছেন ৭২ বছরের গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা। নিরাপত্তার অভাব থাকায় তাঁকে নিজের বাড়ি থেকে এনে পাড়েরহাটের সরকারি আবাসন প্রকল্পে এক কক্ষের একটি ঘর দিয়েছে পুলিশ। সকাল সাতটায় ওই ঘরে আসেন, থাকেন বিকেল পর্যন্ত। সন্ধ্যায় তাঁকে যেতে হয় নৌবন্দর পুলিশ ফাঁড়িতে। রাতে সেখানেই তিনি পুলিশের সঙ্গে থাকেন। আবার সকালে ফেরেন আবাসনের ঘরে।
এই টানাহেঁচড়ার জীবনে অতিষ্ঠ গৌরাঙ্গ সাহা বলেন, ‘সাক্ষ্য না দিতে সাঈদীর ছেলে এক ব্যাগ নিয়া আইছিল। বলছিল, “ভারত চলে যাও।” যাইনি। এখন এই বন্দিজীবন আর ভালো লাগে না। ভগবান যদি নিয়ে যায়, ওইটাই শান্তি।’