ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোট:
সরকারের মেগা প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু চালুর দিন থেকে সেতুর ওপর দিয়ে রেল যোগাযোগ চালুর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এতদিন পরেও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ চালুর বিষয়টি অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার মধ্যে চীন সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা রয়েছে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাকি ১০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়ার কথা। চীন সরকারের পক্ষে এই টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংকের।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে এই প্রকল্পের অর্থ ছাড়তো দূরের কথা, এখনও পর্যন্ত চুক্তিটি পর্যন্ত হয়নি। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, যেখানে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৪১ শতাংশ, সেখানে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে সরকারের নিজস্ব টাকায়। ফলে পদ্মা বহুমুখী সেতু চালুর দিন থেকে রেল সংযোগ চালুর বিষয়টি অনেকটাই অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এটি পদ্মা সেতু প্রকল্পের তুলনায় বড় প্রকল্প হলেও এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি রেল মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করতে গত সপ্তাহে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করে এসেছে। প্রতিনিধি দলে ইআরডি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন প্রতিনিধি ছিলেন। জানা গেছে, এর আগেও বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে এসেছে। আর চায়না এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশ সফরে এসে ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন। কিন্তু দফায় দফায় চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেও অর্থপ্রাপ্তির বিষয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি। ইআরডি’র পক্ষ থেকে চলতি বছরের ১৫ জুনের মধ্যে অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য অনুরোধ করা হলেও চয়না এক্সিম ব্যাংক তাতে সাড়া দেয়নি।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিকে এ প্রকল্পে শতভাগ অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল চায়না এক্সিম ব্যাংক। কিন্তু পরবর্তীতে ৮৫ শতাংশ এক্সিম ব্যাংক ও ১৫ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারকে অর্থায়নের শর্ত দেওয়া হয়। এই শর্তে সম্মতি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হলেও চায়না এক্সিম ব্যাংক টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ১০২ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু অর্থ ব্যয় করতে ব্যর্থ হওয়ায় তা ফেরত দিতে হয়েছে। যে কারণে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদিও আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই প্রকল্পে নতুন করে আরও ৭ হাজার ৯০৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চায়না এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের সহায়তায় অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে কাজ করছে সরকার। আশা করছি, শিগগিরই চুক্তিটি সম্পাদিত হবে। অবিলম্বে প্রকল্পের নির্মাণ কাজও শুরু হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘নির্ধারিত সময়েই পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।’
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের আটটি মেগা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প। এ প্রকল্প চালু হলে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নড়াইল জেলা নতুন করে রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ রুটে কন্টেইনার চলাচলের ক্ষেত্রে কোনও স্পিড ও লোড বিধিনিষেধ না থাকায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফ্রেইড ও ব্রড গেজ কন্টেইনার চালু করা যাবে। রেলের যাত্রী সেবার মান বাড়বে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বরিশাল ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকেও রেল সংযোগের সঙ্গে যুক্ত করতে এই রুটে দ্বিতীয় লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে বলেও জানায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সূত্র।
এ প্রকল্প ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে। ঢাকা-যশোর করিডোরে অপারেশনাল সুবিধাদিসহ সংক্ষিপ্ত রুটে বিকল্প রেল যোগাযোগ স্থাপন করবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু রেল লাইনটি ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে শুরু হয়ে গেন্ডারিয়া- মাওয়া গিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙা জংশন স্টেশন পর্যন্ত যুক্ত করবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাঙা জংশন- বিদ্যমান কাশিয়ানি জংশন স্টেশন – পদ্মবিলা জংশন হয়ে ওয়াই কানেকশনের মাধ্যমে রূপদিয়া এবং সিঙ্গিয়া স্টেশনে যুক্ত করবে। ঢাকা-গেন্ডারিয়া সেকশনে তিন কিলোমিটার ডাবল লাইনসহ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন মেইন লাইন নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ প্রকল্পটি সংযুক্ত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে আগামী ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির অর্থায়নে কারিগরী সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক দিয়ে এ প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত ডিজাইন ও দরপত্র প্রণয়ন সম্পন্ন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় রেল খাতে চীন সরকারের বিনিয়োগের বিষয়টি দুদেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারকে অন্তর্ভুত করা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মোট ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পে চীন সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করবে ১০ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে। একই সঙ্গে পায়রা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তাফা কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত আট মেগা প্রকল্পের সঙ্গে এ বছর এটিও সংযুক্ত হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের তালিকাভুক্ত প্রকল্প। সারাদেশের রেল যোগাযোগের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সংযুক্ত করতেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখবে।’বাংলা ট্রিবিউন