এ ছাড়া অনেক ভুক্তভোগী এসব পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলন করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটি, যশোরের সহসভাপতি সুকুমার দাস বলেন, যার-তার পকেটে ইয়াবা-গাঁজা ঢুকিয়ে মানুষকে জিম্মি করে পুলিশ যে কায়দায় অর্থবাণিজ্য করছে, তাতে যশোরে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। পুলিশ মানুষের রক্ষক হয়ে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাঁচটি ঘটনায় জনতার হাতে আটক হওয়া ১২ পুলিশ সদস্যের মধ্যে একজন উপপরিদর্শককে (এসআই) র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র্যাব), আরেকজনকে এসপিবিএনে বদলি করা হয়েছে।
যশোর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে যশোর পুলিশের ২১৮ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জনকে গুরুদণ্ড (চাকরিচ্যুত, পদাবনতি, বার্ষিক বেতন স্থগিত ও কালো চিহ্ন) এবং ১৯৪ জনকে লঘুদণ্ড (তিরস্কার, সতর্ক ও পানিশমেন্ট ড্রিল) দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান গতকাল রোববার রাতে বলেন, যশোরে এ ধরণের কিছু ঘটনা ঘটেছে। তিনি জানামাত্র ব্যবস্থাও নিয়েছেন। এখন এ ধরণের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধ মামলা করা হবে। তিনি জানান, গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যশোর পুলিশে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন বলে জানান তিনি।
গত শনিবার বিকেলে যশোর সদর উপজেলার বারীনগর বাজারে কোতোয়ালি থানার কনস্টেবল সিরাজুল ইসলাম এক ব্যবসায়ীর
পকেটে ইয়াবা বড়ি ঢুকিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। পিকুল নামের এই ব্যবসায়ী চিৎকার দেন। এতে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে কনস্টেবল সিরাজুলকে ইয়াবা বড়িসহ আটক করে পিটুনি দেয়। এ ঘটনায় কনস্টেবল সিরাজুলসহ দুজনকে আসামি করে গতকাল রোববার কোতোয়ালি থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় সিরাজুলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলায় ওই ব্যবসায়ীকেও আসামি করা হয়েছে।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজমল হুদা বলেন, ‘ওই কনস্টেবল নেশাগ্রস্ত ছিলেন। অতিরিক্ত পুলিশ পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধারের পর যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে ওয়াশ করানো হয়।’
গত ১৮ মে যশোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শার্শা উপজেলার অগ্রভুলট গ্রামের নাসিমা খাতুন অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী হাতেম আলীকে বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সাদাপোশাকে কয়েকজন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। ১১ জুন মনিরামপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঝুমুর নামে এক নারী অভিযোগ করেন, ৬ জুন তিনি ও তাঁর শ্বশুরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান কোতোয়ালি থানার এসআই আসাদ ও দেবাশীষ। এরপর তাঁরা তিন লাখ টাকা দাবি করেন। পরে এক লাখ টাকা দিয়ে তাঁরা ছাড়া পান। পরদিন ওই দুই কর্মকর্তা কিস্তিতে কেনা তাঁর (ঝুমুর) একটি ট্রাক জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে নিতে পারেননি। এ সময় এসআই দেবাশীষ ফোনে দেখা করতে বলেন।
গত ২৮ এপ্রিল যশোর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে কেশবপুর উপজেলার মজিদপুর ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) মনোয়ারা বেগম অভিযোগ করেন, গত ১৯ এপ্রিল কেশবপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তাঁর ছেলে আশরাফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। পরে পুলিশ প্রচার করে, বন্দুকযুদ্ধে আশরাফুল আহত হয়েছেন। তিনটি মিথ্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে।
গত ১৬ মে চৌগাছা উপজেলার খড়িঞ্চা বাজারে ফেনসিডিল দিয়ে চা-দোকানি আবদুর রহমানকে ফাঁসাতে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হন। জনতা তাঁদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পরে এ দুজনসহ পুলিশের তিন সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। প্রত্যাহার হওয়া তিনজন হলেন চৌগাছা থানার এএসআই সাজ্জাদুর রহমান ও মাসুদ রানা এবং কনস্টেবল সেলিম রেজা।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাতে কেশবপুর উপজেলার জাহানপুর বাজারে মুদি ব্যবসায়ী আবদুল লতিফের দোকানে ইয়াবা বড়ি রেখে ফাঁসাতে গিয়ে ধরা পড়েন কেশবপুর থানার ভালুকঘর ফাঁড়ির এসআই মিজানুর রহমান এবং কনস্টেবল ইসমাইল হোসেন, ইউসুফ আলী ও যোবায়ের রহমান। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাঁদের তিন ঘণ্টা একটি দোকানে তালাবদ্ধ করে রাখেন। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তাঁদের প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। মিজানুর রহমানকে পরে র্যাবে বদলি করা হয়েছে।
১০ জুন রাত ১০টার দিকে যশোর শহরের রেল সড়কে সোনালী ব্যাংক ভবনের সামনে এক যুবকের পকেটে গাঁজা ঢুকিয়ে আটক করার সময় স্থানীয় জনগণের হাতে ধরা পড়েন কোতোয়ালি থানার এসআই মাহবুবুর রহমান। স্থানীয় লোকজন পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে আটক করে বিক্ষোভ করলে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
১৩ জুন যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর গ্রামের কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক জাহিদুল ইসলামের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে আটকের চেষ্টা করেন কোতোয়ালি থানার এসআই শামীম আকতার। স্থানীয় লোকজনের প্রতিরোধের মুখে তিনি ওই শিক্ষককে আটক করতে পারেননি। জনতা ফুঁসে উঠলে অপর এক পুলিশ সদস্যের সহায়তায় দ্রুত তিনি সরে পড়েন। এ ঘটনায় পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দেওয়ার দুই দিন পর ১৫ জুন সন্ধ্যায় এসআই শামীমকে প্রত্যাহার করা হয়।প্রথম আলো