বর্তমানে বিশ্বে চালের দাম বাংলাদেশে বেশি। বাকিতে চাল আমদানি করা যাবে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এবারের চালের দাম।

বাকিতে চাল আমদানি করা যাবে

 নিজস্ব প্রতিবেদক
১৯ জুন ২০১৭,

ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকলেও চাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা যাবে। চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা দূর করতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আজ সোমবার ব্যাংকগুলোকে এ পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সুবিধা পাবেন চাল আমদানিকারকেরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে হাওর এলাকার বন্যা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিবৃষ্টিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চালের স্বাভাবিক সরবরাহ বিঘ্ন ঘটেছে—যাতে চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে চাল আমদানিতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিনা মার্জিনে ঋণপত্র খোলার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বাজারে চালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থ জমা দিতে হয়। নগদ টাকা না থাকায় অনেক ব্যবসায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে সুবিধা পাবেন।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এবারের চালের দাম। নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য মোটা চালের দাম এখন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি। শুধু মোটা চাল নয় সব ধরনের চালের দামই বিগত বছরের চেয়ে অনেক বেড়ে যাওয়ায় কষ্টের মধ্যে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষসহ স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা এবং সরু চাল ৫৬ টাকায় উঠেছিল।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চাল-গমের দামবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোটা চালের দাম বিশ্বে এখন বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে পাকিস্তান, যা বাংলাদেশের চেয়ে ১০ টাকা কম। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে সস্তায় চাল বিক্রি করছে ভিয়েতনাম। সেখানে চালের দাম গড়ে প্রতি কেজি ৩৩ টাকা ৬২ পয়সা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি কেজি চালের দাম ৩৪ টাকা ৪৩ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৩৭ টাকা ৮১ পয়সা ও পাকিস্তানে ৩৮ টাকা ৫৪ পয়সা।

সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড। এছাড়া বাজারে নতুন বোরো চাল এলেও পুরনো চালের মতো এই চালের দামও চড়া। যদিও আশা করা হয়েছিল নতুন মৌসুমের ধান উঠলে বাজারে চালের দাম কমবে।

বাজারে চালের এই দাম বৃদ্ধিকে বলা হচ্ছে অস্বাভাবিক। বাবু বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী হাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত বছর যে চাইল ২৬/২৭ টাকা বেঁচছি সেই চাইল এ বছর ৪৬/৪৭ টাকা। মোডা চাইলডা গত বছর বেচ্ছি আপনের ২২/২৩ টাকা এবছর ৪২/৪৩ টাকা কেজি পাইকারি।

প্রায় চার দশকের অভিজ্ঞতা থেকে সাইফুল ইসলাম বলেন, বছরের এ সময়ে চালের দাম এতটা বৃদ্ধি অযৌক্তিক। চালের দাম এ বছরের মতো এতটা চড়া আগে কখনো হয়নি।

চালের দাম দাম বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বর্তমানে যে সরকারি পর্যায়ে চালের মজুদ এটা অনেক কমে গেছে। একই সাথে সাম্প্রতিক যে বোরো সময়টাতে ফসলের উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একটা ব্যহত হয়েছে।

আমরা দেখেছি হাওরে একটা বড় ক্ষতি হয়েছে আর ব্লাস্টের কারণে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। সার্বিকভাবে এটা ১০ থেকে ১১ শতাংশের একটা ক্ষতির আশঙ্কা আছে। সেই ক্ষতির প্রেক্ষিতে এখন বাজারে যেটা আছে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা।

গবেষকরা দেখছেন ১০ টাকায় চাল বিক্রিসহ সরকারি নানা খাদ্য কর্মসূচী নিলেও পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করা হয়নি। সরকারি চালের মজুদ গত বছর এ সময় ছিল প্রায় ছয় লক্ষ টন, এবার সেটি দুই লাখ টনেরও নিচে।

আর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ থাকায় চাল ব্যবসায়ীরাও বেশি পরিমাণে চাল আমদানি করছেন না।

বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কাওসার আলম খান বলেন, এক কেজি চাল ইমপোর্ট করলে আমার ট্যাক্স আসে কেজিতে নয় টাকা। আমি যদি এক হাজার টন ইমপোর্ট করি তাইলে আমারতো ৯০ লাখ টাকা শুল্ক দিতে হয়! যদি কালকে সরকার ঘোষণা দেয় যে আমি শুল্ক উঠাইয়া দেব তাইলেতো আমার ৯০ লাখ টাকা বঙ্গোপসাগরে চইল্যা গেল। তাইলে আমি কেন করবো?

দীর্ঘ চাল ব্যবসার অভিজ্ঞতা থেকে কাওসার আলম খান বলছেন নতুন চাল বাজারে ওঠার পর এত দাম বাড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে দেশে বড় বড় মিল মালিকদেরও ভূমিকা আছে মনে করেন কাওসার খান।

তার কথায়, আজকে থেকে দশ পনের বছর আগে তো ছোট ছোট চালের মিল ছিল। তারা এত হিসাবও করতে পারতো না। সে মার্কেটে কম দামে হলেও বিক্রি করতো। এখনতো সেই মিল আর নাই।

আগামীতে আমি যেটা দেখতেছি আরো বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বড় বড় কোম্পানি আসতেছে। পুরা চাইলটা তাদের হাতে চলে যাইতেছে। তখন তো আরো এমনই থাকবে।

চালের দাম এতটা বৃদ্ধির পেছনে প্রাকৃতিক কারণকেই দায়ী করছেন চালকল মালিকরা। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, বৃষ্টি, বর্ষা, ঝড় আবার হাওরের ধান কিছু নষ্ট হইছে। আবার আমাদের মিলেও কিছুটা চাল নষ্ট হইছে।

আরেকটা কারণ, আমাদের এবার রেশিওটা কম। মানে একমন ধান থেকে আমরা ২৪/২৫ সের চাল পাই কিন্তু এবার আমরা ২০/২২ সেরের বেশি পাচ্ছি না।

তবে বড় মিলাররা ধান চাল মজুদ রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে এমন অভিযোগও আসছে। চালকল মালিক মি. বাবু বলেন, কিছুটা স্টক রাখতে হয় এজন্য যে রানিং ধান কিনে চাল বিক্রি করতে গেলে লস হবে, অনেক লস হবে। আমার মনে হয় এক মাসের ওপর গোটা বাংলাদেশে স্টক রাখা যায় না। এজন্য মিলারদের দোষারোপ করার কিছু নাই।

এবছর বোরো ফলন শেষে সরকারের ৭ লাখ টন ধান ও ৮ লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার ৬শ টনের মতো চাল সংগ্রহ হয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে অসাধু ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা চাল মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চালের বাজার স্বাভাবিক করতে এখন খাদ্য মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

ঢাকার বাবুবাজার আড়তে চালের বস্তা টেনে জীবিকা চালান রাসেল মিয়া। রাসেল বাজারের সবচেয়ে কমদামি মোটা চাল কিনে খান যার দাম এখন কেজি প্রতি ৪৮ টাকা – যা সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

রাসেল বলছিলেন, আমাদের মনে করেন প্রতিদিনের তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি চাউল লাগে। বর্তমানে আমরা রুজি করি ধরেন তিন থেকে চাইরশ ট্যাকা। চাউলেই যদি আমাদের ধরেন দুইশ টাকা যায় গা তাইলে বাজারের ট্যাকা থাকে কইথ্থিকা?

চাল বাজারের দিনমজুর রাসেলের মতো সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষেরা এখন সংকটে পড়েছেন চালের দাম নিয়ে। সংকটে পড়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্তরাও।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।