চতুর্মুখী চাপে অর্থমন্ত্রী

ক্রাইমবার্তা রিপোট:আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি এ পর্যন্ত ১১ বার বাজেট পেশ করেছেন। ৮৩ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট হিসেবে দাবি করেছেন। তবে তার এ ‘শ্রেষ্ঠ’ বাজেটে কেউ খুশি নন। সন্তুষ্ট না হয়ে তার নিজের দলের সংসদ সদস্যরা যেমন তাকে কড়া সমালোচনা করতে পিছপা হননি, তেমনি সমালোচনায় পিছপা হননি সংসদের বিরোধী দলের সদস্যরা। জাতীয় পার্টির একজন সংসদ সদস্য তো রীতিমতো অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।

বাড়তি কর ও ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেয়ায় যেমন সমালোচনা করেছেন দেশের ব্যবসায়ী সমাজ, তেমনি জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সমালোচনা করেছেন ভোক্তাসহ পেশাজীবীরা। এ যেন চতুর্র্মুখী চাপে পড়েছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রাক-বাজেট আলোচনায় ব্যবসায়ীরা দাবি করেছিলেন ভ্যাটের হার কমাতে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটের নতুন হার ১৫ শতাংশই বহাল রাখা হয়। শুধু এক বছরেই ভ্যাটের মাধ্যমে জনগণের পকেট থেকে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। ভ্যাটের এ নতুন হার নিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। কারণ নতুন এ হারে নিশ্চিতভাবে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কারণ বর্তমানে সঙ্কুচিত ভিত্তি মূল্য থাকায় বিভিন্ন হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। যেমন বিদ্যুৎ বিলের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট নেয়া হয়। কিন্তু একক হার হওয়ায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে। নতুন এ ভ্যাট হার নিয়ে সর্বত্রই সমালোচনা শুরু হয়েছে। আর এ সমালোচনা সহ্য করতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে। নতুন ভ্যাট হারের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন আবগারি শুল্ক নিয়ে। কারণ ব্যাংকে লাখ টাকা রাখলেই ৮০০ টাকা কর পরিশোধ করতে হবে আমানতকারীকে। অর্থমন্ত্রী লাখ টাকার মালিকদের সম্পদশালী বলায় বেশি হারে সমালোচিত হন।
মোট দেড় শ’ পাতার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সরকারের নানা গুণগান ও উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরলেও দেশ থেকে টাকা পাচার ও পাচার প্রতিরোধে করণীয় কী তা কোথাও উল্লেখ করেননি। দেশের আর্থিক বা ব্যাংকিং খাতের বর্তমানে কী পরিস্থিতি; খেলাপি কেন বেড়ে চলেছে? তা কমানো যাবে কিভাবে? সরকারি ব্যাংকের অধপতনের নেপথ্যের কারণ কী? বাজেট বক্তৃতায় কোথাও তা উল্লেখ নেই।
আগামী দুই মাসের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে বলে গত ২ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। গত ১৪ জুন বাজেটের ওপর বক্তৃতা দিতে গিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যরা অর্থমন্ত্রীকে কড়া সমালোচনা করেন। সঞ্চয়পত্র সুদের হার কমানোর আগে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কথা মাথায় রাখার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের ছেলে তানভীর ইমাম। তিনি বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর আগে রাজনৈতিকভাবে এটা বিবেচনা করতে হবে। সব দিকে সুদের হার কমানোর আগে বিকল্প বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা উচিত। মনে রাখতে হবে ২০১৮ সালে তারা হবে আমাদের সম্মানিত ভোটার।’
মতাসীন দলের আরেক সদস্য হাবিবে মিল্লাত বলেন, ‘অল্প আয়ের মানুষের কথা চিন্তা না করে বেশি আয়ের মানুষের কাছ থেকে কর নেয়ার বিষয়টি চিন্তা করতে হবে। শুধু খামোশ বা রাবিশ বলে দায় এড়ানো যাবে না। অর্থমন্ত্রী আর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছে, সবাইকে বোঝাতে হবে, কর আরোপের ফলে কার তি হচ্ছে।’
ওই দিন জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম মিলন এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ‘বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন। ঘাটতি বাজেট বাস্তবায়ন আরো কঠিন। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সমতা নেই। কী করে এত অর্থ আদায় করবে? অর্থমন্ত্রী সব মানুষের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন।’
একই দিনে জাতীয় পার্টির ইয়াহিয়া চৌধুরী ব্যাংক হিসাবে আবগারি শুল্ক আরোপের সমালোচনা করে একে ‘পাপকর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘সমাজের জন্য তিকারক জিনিসের ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। আমার প্রশ্ন হলোÑ আমার বৈধভাবে অর্জিত টাকা কিভাবে পাপকরের আওতায় আনা হলো?’ ‘এক লাখ টাকার মালিকদের সম্পদশালী বলে অর্থমন্ত্রী ােভের আগুনে ঘি ঢেলেছেন। মানুষকে উপহাস করেছেন।’
১৫ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী অর্থমন্ত্রীকে কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক আমানতে বাড়তি আবগারি শুল্ক থেকে সরকার কত পাবে? আয় আসবে ২০০ কোটি টাকার মতো। এর জন্য বিপুল লোকের আয় কমিয়ে দেবো?’ তিনি বলেন, ‘পুরো প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিলে তি হবে ৩৫৫ কোটি টাকা। এটি অর্থমন্ত্রীর জন্য, আমাদের বাজেটের জন্য পিনাট। সেখানে কেন উনি (অর্থমন্ত্রী) হাত দিচ্ছেন?’
বাজেট আলোচনায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর বিরোধিতা করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ কমানো ঠিক হবে না। ১০ শতাংশ সুদ ধরলে হয়তো হবে এক হাজার কোটি টাকা। এর সুবিধা পাবে লাখ লাখ লোক। যাদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প নেই। তারা ট্রাকের সামনে দাঁড়াতে পারেন না, হাত পাততে পারেন না। এদের অনেকে সিনিয়র সিটিজেন। নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অনেক শ্রেণীর মানুষকে ভর্তুকি দেই, যারা প্রাপ্য নয়। তার চেয়ে বড় কথা, ঋণখেলাপিদের বিশাল? বোঝা নিতে পারলে আমরা কেন মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্তের সামান্য বোঝা নেবো না। প্রব্লেম একটাই, এদের প্রেসার গ্রুপ নেই, থাকলে লেজ গুটায়ে মেনে? নেয়া হতো।’
গত ২০ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের সমালোচনা করে তিনি অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। একই সাথে তিনি অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘ফৌজদারি অভিযোগ’ দায়ের করারও দাবি তোলেন। অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ট্যাক্স পেয়ারের দুই হাজার কোটি টাকা উনি ব্যাংকিং খাতের ঘাটতি পূরণে দিচ্ছেন। মানুষের টাকা দিয়ে লুটপাটের টাকা পূরণ করছেন। এটা কোনো নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। এটি অনৈতিক কাজ। উনি নৈতিকতা ও আইনবিরোধী প্রস্তাব কিভাবে করেন?’ ‘লুটের টাকার ঘাটতি’ পূরণে করদাতাদের দেয়া অর্থ খরচের অধিকার অর্থমন্ত্রীর নেই মন্তব্য করে বাবলু বলেন, ‘এর জন্য তো ওনাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থমন্ত্রীকে এ জন্য আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। ওনার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল চার্জ আনা উচিত বলে আমি মনে করি।’ মুহিতের উদ্দেশে বিরোধী দলের এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘আপনি বিদায় নিন। পদত্যাগ করুন। সম্মানের সাথে বিদায় নিন। আপনার অনেক বয়স হয়েছে। আপনাকে সম্মান করি। বিদায় নিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে মুক্তি দিন।’
ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ এনে ওই দিন বাবলু আরো বলেন, ব্যাংকগুলোকে ‘অক্সিজেন দিয়ে’ রাখা হয়েছে। ‘ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। খেলাপি ঋণে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে আছে। এর মধ্যে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। কার টাকা অবলোপন করছেন? মানুষের টাকা লুট হচ্ছে, বিদেশে পাচার হচ্ছে। এসব নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই।’ খেলাপি ঋণ আদায় হলে ভ্যাট বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না বলেও মনে করেন বাবলু।
তিনি বলেন, ‘লুটপাট কারা করছে? এরা কি আপনাদের চেয়ে, সরকারের চেয়ে শক্তিশালী? কেন তাদের আইনের আওতায় আনবেন না? বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুদক নাকি তার বিরুদ্ধে কিছু পায়নি।’ ‘বিচিত্র দেশের বিচিত্র মন্ত্রীর বিচিত্র বাজেট’ মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে বাবলু বলেন, ‘আপনি কি উন্নয়নের মহাসড়কে নাকি দুর্যোগের মহাসড়কে আছেন সেটা বিবেচনার বিষয়।’
ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক ভুল বার্তা দিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এ শুল্কের নাম পরিবর্তন করবেন। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখলেও কানা ছেলে কানাই থাকে।’
এর আগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠন অর্থমন্ত্রীর আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর কড়া সমালোচনা করেন।
বাজেট নিয়ে ঘরে-বাইরে যখন অর্থমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা মুখে পড়েছেন, তখন নতুন ভ্যাট আইনের পরিবর্তন হওয়ার আভাস দিয়েছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী নিজেই। অর্থমন্ত্রী এর ইঙ্গিত দিয়েছেন গত ১৮ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ওই দিন সচিবালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালের বার্ষিক কর্মসম্পাদনা চুক্তি স্বার অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটে ওই প্রস্তাব নিয়ে বাজারে ‘এত চিৎকার’ হচ্ছে যে, সবাইকে স্বস্তি দিতে তিনি সংসদে কথা বলার আগেই পরিবর্তনের বিষয়টি জানিয়ে রাখছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে বলেছি, এত চিৎকার যখন বাজারে আছে, সুতরাং এগুলো একটু সাম পরিবর্তন সেখানে হবে।’ কথাটা বললাম এ জন্য যে কথাটি পার্লামেন্টে বলতে আমার অনেক দেরি হবে। পার্লামেন্টে বলতে ২৮ তারিখ পর্যন্ত চলে যাবে। তার আগেই যাতে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস অনেকে ফেলতে পারে, সে জন্য কথাটা বললাম।

 

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।