নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পিরোলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ও দু’টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পিরোলী গ্রামের সহস্রাধিক নারী-পুরুষ এক মাস যাবৎ বাড়ি ছাড়া রয়েছেন। কোনও কোনও বাড়িতে শিশু ও নারীরা থাকলেও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এখানে নেই ঈদ আনন্দ। কেনা হয়নি নতুন পোশাক ও ফিরনি, সেমাই। ফলে পিরোলী গ্রামের প্রায় দু’শ পরিবারে থাকছে না কোনও ঈদ! নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পিরোলী ইউনিয়ন পরিষদের বিদায়ী চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বাবু জানান, গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত পিরোলী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দু’দিন পর (২৫ মে) আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে কালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোফাজ্জেল হোসেন (৫২) নিহত হন। ওইদিনের সংঘর্ষে গুরুতর আহত প্রতিপক্ষের বদরুল ইসলাম (৫১) ২৭ মে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নিহত মোফাজ্জেল নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জারজিদ মোল্যার সমর্থক ছিলেন। আর নিহত বদরুল পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন ইকবালের সমর্থক ছিলেন, তিনি পিরোলী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিরোলী গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বাংলা ট্রিবিউিনকে জানান, আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জেল হত্যাকাণ্ডের পর পিরোলী গ্রামে প্রতিপক্ষের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। প্রতিপক্ষের পাকা ও টিনের ঘরগুলো এবং ভেতরের আসবাবপত্র ভেঙে ফেলা হয়। এছাড়াও ধান, গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন ফসল লুটপাট করা হয়। এমনকি শিক্ষার্থীদের বইখাতাসহ শিক্ষা উপকরণ পর্যন্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছে।
এদিকে, সংঘর্ষে আহত আওয়ামী লীগ নেতা বদরুলের মৃত্যুর পরও প্রতিপক্ষের লোকজনের বাড়িতেও একইভাবে ভাঙচুর ও লুটপাট করে প্রতিপক্ষ। ঘটনার এক মাস পর শুক্রবার (২৩ জুন) পিরোলী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির বিশেষত পুরুষেরা এখনও বাড়ি ছাড়া।
পিরোলী গ্রামের রোজি বেগম বলেন, ‘প্রতিপক্ষের লোকজন প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে নারীদের মারধর করছে। বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরণের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।’ স্থানীয় মধ্যপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র সাফায়েত জানান, বাড়িতে কেউ থাকতে পারছে না। প্রতিপক্ষের ভয়ে তার বাবা বাড়িতে থাকতে না পারায় তাদের ঘরে ঈদের আনন্দ নেই।
ওই গ্রামের রেজাউল মোল্লার স্ত্রী হেমেলা বেগম বলেন, ‘সেমাই ও চিনি কেনার টাকাও নেই। ধানসহ সব লুট করে নিয়ে গেছে মোফাজ্জেলের সমর্থকরা। কি দিয়ে ঈদ করব। স্বামী ও দুই ছেলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমি এখন পরের বাড়ি খাই।’
পিরোলী গ্রামের কয়েকজন নির্যাতিত নারী জানান, বাড়িঘর ও আসবাবপত্র ভাঙচুরের পাশাপাশি টিউবওয়েল, থালাবাটি, জগ, মগ, গ্লাসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে। এমনকি সেহরি ও ইফতার খাওয়াও কঠিন হয়ে গেছে অত্যাচার আর নির্যাতনে।
তবে পিরোলী ইউনিয়ন পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যা বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পিরোলী গ্রামে দু’পক্ষের সংঘর্ষে মোফাজ্জেল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ইউনিয়নের কোথাও কোনও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি।’
পিরোলী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এটিএম তসরিফুজ্জামান বলেন, ‘পিরোলী গ্রামে পুরুষ ও নারীরা বাড়ি ছাড়া কি না তা আমার জানা নেই। আসামিরা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে থাকতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তৎপর রয়েছে।’
কালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল গনি জানান, পিরোলী গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেন ও বদরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে। দু’টি মামলায় এজাহারভূক্ত আসামিদের গ্রেফতারে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে পুলিশি টহল জোরদার করা হয়েছে।’http://m.banglatribune.com/
/