এঘটনায় ১০জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১জন নারী ও ১জন শিশু রয়েছে।
দুর্ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া একাধিক যাত্রী বলেছেন, চালকের ঘুমের কারণেই এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে।
ঘটনার সময় ট্রাকের সহকারী বেপরোয়া গতিতে ট্রাকটি চালাচ্ছিল বলে ট্রাকযাত্রীদের অভিযোগ। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে।
ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য গাজীপুর থেকে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ ও রংপুরের পীরগঞ্জে ফিরছিল ৫৫ পোশাক শ্রমিক। সেই আনন্দ ম্লান করে দিয়ে তাদের পরিবারগুলোকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিল সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক উল্টে।
দুর্ঘটনায় আহত যেসব পোশাক শ্রমিক গাজীপুর থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তারা জানান, বাসের টিকেট না পেয়ে গাজীপুর থেকে একটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে (রংপুর-ট ১১-০৩২৮) করে ঈদের জন্য বাড়ি ফিরছিল সবাই।
২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই ট্রাকচালক ৫৪ জন পোশাক শ্রমিককে ট্রাকে তুলে নেন। পোশাক শ্রমিকরা স্বামী,স্ত্রী ও সন্তানসহ বাড়ি ফিরছিলেন পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের জন্য।
গত শুক্রবার রাতেই ওই ট্রাকচালক সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জে যাচ্ছিলেন। ট্রাকের কেবিনে থাকা পোশাক শ্রমিক জামিনা বেগম (২৭) জানান, ট্রাকের চালক ঘুমের কারণে বারবার ট্রাকের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না।
এ অবস্থায় ট্রাকের যাত্রীরা চালককে গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চালাতে নিষেধ করলেও তিনি শোনেননি। যাত্রীদের সঙ্গে এ নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ট্রাকচালক ট্রাকের কেবিনেই ঘুমিয়ে পড়েন।
এ সময় চালকের আসনে বসেন ট্রাক চালকের সহকারী। সেও একইভাবে টালমাটাল অবস্থায় ট্রাকটি চালিয়ে আসছিল। এ অবস্থায় সকাল পৌনে ৫টার সময় ট্রাকটি পীরগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ডে এসে ২০ জন যাত্রীকে নামিয়ে দেয়।
পীরগঞ্জ থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে কলাবাগান নামকস্থানে ট্রাকটি পৌঁছলে দ্রুত ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশেই খাদে উল্টে যায়। এ সময় ট্রাকের সিমেন্টের বস্তার নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে ১১ জন মারা যান।
গুরুতর আহত বেশ কয়েকজনকে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে সেখানে ৫জন মারা যান। পরে রংপুর মেডিকেলেও একজনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার সময় আহতদের আর্তচিৎকারে মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয়। এর মাঝেও স্থানীয়রা উদ্ধারের নামে ব্যাপক লুটপাট চালায়।
তারা মৃতদের শরীর হাতিয়ে টাকা পয়সাসহ মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি ভয় দেখিয়ে আহত ও অন্য নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে তাদের সোনার গহনা গলা ও কান থেকে খুলে নিয়ে যায় বলেও অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী।
ভয়াবহ ঘটনার বর্নণা করেছে ৫ম শ্রেনীর ছাত্রী ঝর্না খাতুন ও তার মা জামিনা বেগম (২৭)।
নিহত যাত্রীরা হলেন- লালমনিরহাট কালিগঞ্জের মুনিরুজ্জান মিয়া (২৫), কালিগঞ্জের ঘোংগাগাছ এলাকার দেলোয়ার হোসেন (২৮), কালিগঞ্জের লতাবর গ্রামের আপন দু’ভাই সাদ্দাম হোসেন (২০) ও আলমগীর হোসেন (২৫), কালিগঞ্জের উত্তর বত্রিশ হাজারী গ্রামের শহিদুল ইসলাম (৩০), মজনু মিয়া (২৫), সুবর্না খাতুন (৯), কোহিনুর হক (৪০), আদিতমারীর আজিজুর রহমান(২২), মহিশ খোচার রবিউল ইসলাম(২২), বালা পাড়ার মহসিন হোসেন (২০), ময়মনসিংহের ভালুকার জমিস উদ্দিন(৪৫), চাঁপার হাটের নুরুন্নবী মিয়া(২৭), ঝিনাইদহের শৈলকুপার আনিসুজ্জামান মিয়া(৪০) ও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীর নাসিমা আকতার(২৫)। দু’জনের নাম জানা যায়নি।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন রংপুর জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি এ সময় নিহতদের জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেন।
তিনি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেন নিহতদের লাশ নিয়ে যেন পরিবারের লোকজন কোনো ভোগান্তিতে না পড়ে সেদিকে নজর দিতে। জেলা প্রশাসক রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের খোঁজ খবর নেন।
পীরগঞ্জ প্রতিনিধি গোলাম কবির বিলু জানিয়েছেন, নিহত যাত্রীদের লাশ পীরগঞ্জের বড়দরগা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে।
লাশ নিতে আসা লালমনিরহাটের কালিগঞ্জের ঘোংগাগাছ গ্রামের সহির উদ্দিন জানান, তার পরিবারের ৪ জন মারা গেছে। তারা হলো আপন দুই ভাই সাদ্দাম হোসেন ও আলমগীর হোসেন, তার দুই ভাতিজা মনিরুজ্জামান ও দেলোয়ার হোসেন।
এরা সবাই পোশাক শ্রমিক। নিহত ওই ৪ জনের স্ত্রী, কন্যারা জীবিত আছেন। পীরগঞ্জ থানার ওসি রেজাউল করিম জানিয়েছেন, নিহতদের পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লাশের ময়নাতদন্ত করা হবে। তা না হলে সরাসরি লাশ পরিবারের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ ঘটনা স্থলে গিয়ে নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে।
খবর পেয়ে লালমনিরহাট জেলা কালিগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমল কুমার ঘোষ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। নিহত যাত্রীদের লাশ যেন ঠিকমতো বাড়ি নেয়া যায় সে বিষয়ে তিনি তদারকি করেন।