এঘটনায় খামারের যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ মোফাজ্জল হোসেনসহ ৩জনকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। বরখাস্ত হওয়া অন্য দু’জন হলেন, উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) জাহাঙ্গীর আলম ও স্টোর কিপার আমজাদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক ফেক্সবার্তায় বিএডিসি’র সচিব তুলসি চন্দ্র এই বহিস্কারের আদেশ দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন ঘটনার তদন্ত টিমের সদস্য ও বিএডিসি দিনাজপুর অঞ্চলের সার বিপণনের যুগ্ম পরিচালক আ.ফ.ম.আফরোজ আলম। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান।
জানা গেছে, নশিপুরভিত্তিক পাটবীজ খামারের গোডাউন থেকে পাচার হওয়া ১৬০ বস্তা বীজ গম মঙ্গলবার দুপুরে আটক করে স্থানীয় জনতা ও খামারের শ্রমিকরা। পরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.আব্দুর রহামানের নেতৃত্বে পুলিশ ও র্যাবসহ প্রশাসন এসব গম জব্দ করে। ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেই নশিপুর পাটবীজ খামারের সব গুদাম সিলগালা করে দেয় জেলা প্রশাসন।
এর আগেও অসংখ্যবার এ খামার থেকে বীজ গম ও ধান পাচারের পর জনতার চোখে ধরা পড়ে । তবে প্রতিবারই ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায় সংশ্লিষ্ট পাচারকারীরা। ভেতর-বাইরের একটি চক্র এই খামার থেকে দীর্ঘদিন ধরে পণ্য ও মালামাল চুরি এবং পাচারের সঙ্গে জড়িত।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারি এ খামারটি রীতিমতো লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চুরি ও পাচারের কারণে খামারটি ভেস্তে গেছে। পরিণত হয়েছে লোকসানের প্রতিষ্ঠানে।
খামারের শ্রমিক এবং স্থানীয়রা বলছেন, শুধু ১৬০ বস্তা গমই নয়, বিএডিসির বৃহত্তম এ পাটবীজ খামারটিতে চলছে পাচারের মহোৎসব। গত কয়েকদিন আগেও পাচার হওয়া ধান আটক করেন স্থানীয়রা। খামারের কতিপয় চিহ্নিত কর্মকর্তা এবং শ্রমিক লীগ নেতা এ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে তাদের অভিযোগ।
৬২০ একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত বিএডিসি-দিনাজপুরের নশিপুর পাট বীজভিত্তিক এ খামার। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫১০ একর। পাটের ঐতিহ্য হারানোর পর দেশের সর্ববৃহৎ এ খামারটিতে এখন নামমাত্র পাটবীজ উৎপাদন করা হলেও মূলত আবাদ করা হচ্ছে- ধান, গম, আলুসহ বিভিন্ন ফসল।
মঙ্গলবার খামার হতে দেড় কিলোমিটার দূরে এক ব্যক্তির গুদাম থেকে নশিপুর পাটবীজ খামার হতে পাচার হওয়া ১৬০ বস্তা বীজ গমের খোঁজ পান খামারের শ্রমিক ও স্থানীয় জনতা। পরে খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসন পুলিশ ও র্যাবের সহযোগিতায় তা জব্দ করে। দিনাজপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো সাইদুল আলম জানায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশেই টেক্সটাইল মিলের গুদাম থেকে নশিপুর পাটবীজ খামারের ১৬০ বস্তা গম উদ্ধার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা জানান, এর আগে ২৪ জুন সাত মাইল এলাকার তাহেরের মিল হতে নশিপুর খামারের ২৪ বস্তা ধান এবং এর আগের দিন দিনাজপুর পুলহাট এলাকা থেকে ১০০ বস্তা ধান আটক করা হয়। আটক ২৪ বস্তা ধান স্থানীয় চেহেলগাজী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মকসেদ আলীর বাড়িতে জমা রয়েছে। তবে পুলহাটে আটক ধানের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এর আগেও ঠাকুরগাঁও ও গড়েয়া নামক স্থানে নশিপুর পাটবীজ খামারের ধান ও গম আটক করা হয়েছে। তবে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
মঙ্গলবার আটক করা ১৬০ বস্তা গমের ক্রেতা আবদুল কাদেরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি খামারের জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি আবদুল জব্বারের কাছ থেকে প্রতি বস্তা (৭৫ কেজি) ১৪শ’ টাকা দরে ১৬০ বস্তা গম ক্রয় করেন। পরে তিনি এগুলো ভাড়ায় নেয়া সরকারি টেক্সটাইল মিলের গুদামে রাখেন।
এব্যাপারে নশিপুর পাটবীজ খামার শাখার জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি আবদুল জব্বার জানান, তিনি কোনো কর্মকর্তা নন। এমনকি গুদামের চাবিও তার কাছে থাকে না। তিনি যা করেছেন তা কর্মকর্তাদের নির্দেশেই করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি কর্মকর্তা হিসেবে নশিপুর পাটবীজ খামারের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) জাহাঙ্গীর আলমের নাম বলেন।
তবে জানতে চাওয়া হলে খামারের ডিএডি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। অন্য কেউ এ কাজের সাথে জড়িত।
নশিপুর পাটবীজ খামারের জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নিতাই চন্দ্র শীল জানান, খামারে উৎপাদিত খাদ্যশস্য দীর্ঘদিন থেকে চুরি ও পাচার হওয়ায় খামারটি লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তিনি জানান, পাটবীজ খামারের যুগ্ম পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, ডিএডি জাহাঙ্গীর আলমসহ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং শ্রমিক লীগ সভাপতি আবদুল জব্বার এ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, নিয়মিত চুরি ও পাচার হওয়ায় খামারটিতে লোকসানের কারণে শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতাও ঠিকমতো পাচ্ছেন না। তিনি জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
একই কথা বলেন শ্রমিক নেতা হায়দার আলী, হামিদুল আলম, মাসুদসহ অন্য শ্রমিকরা। তারা জানান, শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল জব্বারের সঙ্গে যোগসাজশ করেই এ পাচার ও চুরি চালিয়ে আসছেন যুগ্ম পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, উপ-সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্য কর্মকর্তারা। তারা যুগ্ম পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন, উপ-সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ পাচারের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অপসারণ দাবি করেন।
খামারের যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ মোফাজ্জল হোসেন পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে জানান, যারা পাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলমজানান, পাচার করা ১৬০ বস্তা গম জব্দ করার পর মঙ্গলবার রাতেই খামারের সব গুদাম সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিএডিসি কর্তৃপক্ষ এডিশনাল জেনারেল ম্যানেজার ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করেছেন। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, বিএডিসি দিনাজপুর অঞ্চলের বীজ সংরক্ষণ এর যুগ্ম পরিচালক আলতাফ হোসেন ও সার বিপণনের যুগ্ম পরিচালক আ.ফ.ম আফরোজ আলম।