ক্রাইমবার্তা আন্তর্জাতিক ডেস্ক :১৯৯৬ সালে সিয়াটেল এলিমেন্টারে স্কুলে ৪ সন্তানের জননী ও ৩৪ বছরের স্কুল শিক্ষিকা মেরি কে লেটরিনউ তার ১২ বছরের ছাত্রের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত অবস্থায় ধরা পড়েন। এরপর একই ছাত্রের সঙ্গে গাড়িতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। এরপর বিচারে তার ৭ বছরের জেল হয়। যৌন অপরাধী হিসেবে তার নাম পুলিশের খাতায় নিবন্ধন করা হয়।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র। আশঙ্কার কথা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে এধরনের ঘটনা এবং খবর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা অনেকেই দেখতে পছন্দ করেন না। এধরনের ঘটনায় অনেকের বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে ও নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সচেতনতার অভাবকেই এধরনের সমস্যার প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো এধরনের খবর লুফে নিচ্ছে এবং সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এধরনের ঘটনায় জড়িতদের আবেদনময়ী ছবি, আদালতে হাজিরা দেওয়া বা পুলিশ বেষ্টনীতে অপরাধী শিক্ষিকার ছবি সংবাদগুলোতে স্থান পাচ্ছে। চাকরি হারাচ্ছেন অনেক শিক্ষিকা। এমন শিক্ষিকার মধ্যে যেমন বিবাহিত রয়েছেন, রয়েছেন স্বামী পরিত্যক্তা। এমনকি অবিবাহিতা শিক্ষিকাও এধরনের অপরাধে জড়িয়ে ফেলছেন নিজেকে।
কখনো কখনো শিক্ষিকা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তার ছাত্রকে প্রলুব্ধ করছেন। নগ্ন ছবি পাঠাচ্ছেন। ছাত্রকে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন, শপিং মলে, বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার নাম করে শোবার ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন, ক্লাস শেষ হলেও তাকে অপেক্ষার জন্যে বলে নিরিবিলি কাছে টানছেন শ্রেণীকক্ষে, ইমেইল পাঠাচ্ছেন ছাত্রকে, সঙ্গে নিজের গোপন ছবি, টেক্স বার্তা, এধরনের যথেষ্ট আপত্তিকর আবেদনের পর দেখা যাচ্ছে বালক থেকে শুরু করে অপরিণত বয়সের ছাত্র হয়ে উঠছে শিক্ষিকার বন্ধু এবং বন্ধুত্বের আবেদন যেয়ে ঠেকছে যৌনতায়। গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন কোনো কোনো শিক্ষিকা। সন্তান সম্ভাবনা হয়ে কারাগারে যাচ্ছেন, সেখানেও সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এধরনের ইত্যাকার অনাচার হয়ে উঠছে অপরাধের পূর্ব লক্ষণ বা ভার্চুয়াল সিন্ড্রোম। এবং যা সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে তা ‘টিপস অব দি আইসবার্গ’ বা অতি সামান্যই। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে নীতি নৈতিকতার বালাই ফেলে এধরনের অপরাধ সামাজিক স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে কি না।
কেনটাকির বিবাহিত শিক্ষিকা সাতাশ বছরের লিন্ডসে জারভিস যার বিরুদ্ধে তার ছাত্রকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। কানেকটিকাটে একই মাসে একত্রিশ বছরের শিক্ষিকা লরা রামোস একই অপরাধে চাকরি হারান। চব্বিশ বছরের লরিন বার্কলে বদলি শিক্ষিকা হিসেবে পড়ানোর সময় আরেক ছাত্রকে ধর্ষণ করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। জনপ্রিয় কৌতুহলের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়া এসব অপরাধ সত্যিই অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। গবেষকরা এসব সিন্ড্রোমের সুযোগ ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন।
মন্ট্রিলের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সোশিয়াল ওয়ার্ক’এর সহযোগী অধ্যাপিকা মিরিয়াম এস দেনভ বলেন, নারী সম্পর্কে সাংস্কৃতিক রীতিনীতি লুপ্ত পাওয়ায় ও নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ায় ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষিকার যৌনতা এ ব্যাপারে সচেতনতাকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও পুরুষ যৌন অপরাধীদের তুলনায় নারীদের এধরনের যৌন আগ্রাসনের হার ছোট তবুও এধরনের ঘটনা কম স্বীকৃতি পাচ্ছে বা নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এই অধ্যাপিকা তার ‘পার্সপেক্টিভস অন ফিমেল সেক্স অফেন্ডিং: এ কালচার অব ডেনিয়াল’ বইতে বলেছেন, প্রকৃত ঘটনার এমন একটি বড় তথ্য রয়েছে যা সম্ভাব্য যৌন আগ্রাসীদের মত নারীর ব্যাপক অখ-তায় সমস্যাটির সত্যিকারের মাত্রাকেই অস্পষ্ট করতে পারে।
মার্কিন বিচার বিভাগের ‘সেন্টার ফর সেক্স অফেন্ডার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের তথ্যে দেখা গেছে যৌন অপরাধের মাত্র ১০ ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা দায়ী। কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে শিক্ষিকাদের জড়িত থাকার পরিমাণ ৩০ ভাগ। তিন বছর আগে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যে স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা বা কর্মচারির মাধ্যমে ঘটে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ৮’শ যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে এক তৃতীয়াংশেই নারীরা জড়িত।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কেন কিছু নারী বালকদের সঙ্গে যৌনতায় জড়িত হয়ে পড়ছেন তার ওপর আলোকপাত করছেন। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডা: ডোমেনিক স্পোর্টেলি ফক্স নিউজকে জানান, শিক্ষক বা শিক্ষিকা অপরিণত বয়স্ক ছাত্রদের সঙ্গে কেন যৌনতায় জড়িয়ে পড়ছেন তা অবিশ্বাস্য এক জটিল বিষয়। শিক্ষার্থীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে শোষণ করার ‘শিকারী’ মানসিকতাও এর একটি কারণ। এধরনের যৌন নিগ্রহ করার বিষয়টি ক্ষমতার বহি:প্রকাশ, আধিপত্য বজায় রাখা ও শিক্ষার্থীকে নিয়ন্ত্রণ করার মত বিষয় থেকেও এর উৎপত্তি হতে পারে। সম্ভবত কোনো শিক্ষিকা একাকিত্ব, বর্তমান সম্পর্ক থেকে সৃষ্ট হতাশা, কারো প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হওয়া, ভোগ বা লালসার বশবর্তী কিংবা সত্যিকারের ভালবাসা অনুভব করেও এধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এধরনের অনেক ঘটনায়, অপরাধীর যৌন ও মানবিক অপরাধের ইতিহাস রয়েছে। মানসিক কোনো রোগ, ব্যক্তিত্বহীনতা, পূর্বে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এমন কোনো শিক্ষিকা তার ছাত্রের ওপর চড়াও হতে পারে।
এদিকে আইনজীবীরা বলছেন, আদালতে কিভাবে নারী ও পুরুষ যৌন নির্যাতনকারীদের ব্যাপারে দ্বৈতনীতি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। পুরুষরা সাধারণত বিশ্বাস করে যখন সে কোনো কিশোরীকে ধর্ষণ করে সেও শিক্ষকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক উপভোগ করে। মানুষ এধরনের শিক্ষকদের শিকারি হিসেবে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্রে কলোরোডোর যৌন হুমকি ও স্কুল সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ স্টিভ আলবার্ট ফক্স নিউজকে বলেন, শিক্ষিকারা প্রায়শ: অসহায়, বিভ্রান্ত কিংবা অপূর্ণতায় এধরনের স্খলন ঘটিয়ে থাকেন। যদিও তারা তাদের বালক ছাত্রদের হিংসাত্মক আচরণেই শিকার করে থাকেন।
এধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে বিচারে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য না হওয়ার কথা। দুর্ভাগ্যবশত, কোনো বালকের যৌন নির্যাতন হওয়ার বিষয়টি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রিমিনাল ডিফেন্স এ্যাটর্নি লিও টেরেল বলেন, এর কারণ হচ্ছে শারীরিকভাবে ছেলেরা নির্যাতন প্রতিরোধ করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। এধরনের একটি প্রাগৈতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত অপরাধী কে তা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। শিক্ষকদের এধরনের অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো জাতীয় পরিসংখ্যান না থাকলেও নিউজার্সির দৈনিক স্টার লেজার’এর ১০ বছরের এক তদন্তে দেখা যায় এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে শিক্ষকরা শিক্ষিকাদের চেয়ে কঠিন শাস্তি পেয়ে থাকেন। গার্ডেন স্টেটে পুরুষ যৌন অপরাধীদের ৫৪ ভাগ কারাগারে গেলেও নারীদের ক্ষেত্রে গিয়েছে ৪৪ ভাগ। পুরুষরা এক্ষেত্রে গড়ে চব্বিশ মাস জেল খাটলেও নারীরা খাটেন ষোল মাস। নারী যৌন অপরাধী সর্ব্বোচ্চ ৭ বছর জেল খাটলেও একই ধরনের পুরুষ অপরাধী খেটেছে ১০ বছর।
৬ বছর আগে ডেনভার পোস্ট দেখতে পায় ছোটখাট কোনো যৌন অপরাধের জন্যে নারীদের জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু তার আগের ৫ বছরে দুই হাজার ১’শ আটাশ জনের মধ্যে অর্ধেক পুরুষকেই জেলে পাঠানো হয়েছিল। একই সময় ৭৯ জন নারী একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর তাদের ৩৮ ভাগ জেলে যায়। যৌন নির্যাতনের শিকার ছেলে না মেয়ে তার চেয়ে বরং নির্যাতনকারী কোন লিঙ্গের তা বিবেচনায় নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আলবার্ট আরো বলেন, যখন নির্যাতিত বালক প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখন তার মধ্যে নির্যাতনে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি একটি স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের দ্বারা তারা নিগৃহীত হওয়ার পর তা দীর্ঘস্থায়ী একটি ক্ষতির কারণ হয়ে পড়ে।